
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী। গড় ফেল করেছে ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় ফেলের হার ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। কমেছে জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যাও। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। যা গত বছরের তুলনায় ৪৩ হাজার ৯৭ জন কম পেয়েছে। ২০০৯ সালের পর এবারই সর্বনিম্ন ফল। শিক্ষা বোর্ড বলছে, চলতি বছর শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়নি অতিরিক্ত নম্বর বা গ্রেস মার্ক। যার ফলে কমেছে পাসের হার ও জিপিএ-৫। এটাই প্রকৃত ফল। এখন প্রশ্ন উঠছে, এই যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করলো, এর দায়টা কার?
বৃৃহস্পতিবার প্রকাশিত চলতি বছরের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবথেকে বেশি ফেল করেছে গণিতে। ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ ছাড়াও ইংরেজিতে ফেল করেছে ১২.৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। সবথেকে কম পাস করেছে বরিশাল বিভাগে। গণিতে ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও ইংরেজিতে ফেল করেছে ৩০ দশমিক ৩৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের একজন শিক্ষক জানান, তার স্কুলে ২৮ জন শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে। স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের বিশেষ কোচিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের স্কুলে ৩ জন গণিতের শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু আমরা ২ জন দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। যার মধ্যে একজন গণিতের শিক্ষকই না। যার কারণে আমাদের ওপর চাপ বাড়ছে। তিনি যোগ করেন শিক্ষকদের জরুরিভিত্তিতে বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।
এই শিক্ষকের কথার সঙ্গে মিল রয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষা-তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যানে। মাধ্যমিক পর্যায়ের গণিত ও ইংরেজি বিভাগের ৮৪ শতাংশ শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি নেই। বিজ্ঞান বিভাগে যারা লেখাপড়া করেছেন তাদের দিয়েই ক্লাসগুলো নেয়া হয়।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের প্রায় ৮৫ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। ২০২৩ সালে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী প্রকাশিত এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় মোট ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৫৭ জন। তাদের মধ্যে ইংরেজিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ৪ হাজার ১৫৮, যা মোট শিক্ষকের ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক ৫ হাজার ২১৮, যা মোট শিক্ষকের ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সে অনুযায়ী ইংরেজির শিক্ষকদের ৯ হাজার ৩৭৬ জন বা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিষয়ভিত্তিক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। আর ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর নেই ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশের।
মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় মোট গণিত শিক্ষকের সংখ্যা ৬৪ হাজার ১৪৭। তাদের মধ্যে গণিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারী শিক্ষক মাত্র ৩ হাজার ৮৩৬ জন; ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ৪ হাজার ৬৪৩ জন; ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। মোট ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ইংরেজি বিষয়ে একই চিত্র। ইংরেজিতে মাত্র ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বা ৩ হাজার ১৪৭ জন শিক্ষক সংশ্লিষ্ট বিষয়ের। মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় মোট ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৫৭ জন। তাদের মধ্যে ইংরেজিতে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ৪ হাজার ১৫৮; ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষক ৫ হাজার ২১৮; ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। সে অনুযায়ী ইংরেজির শিক্ষকদের ৯ হাজার ৩৭৬ জন বা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিষয়ভিত্তিক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। আর ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর নেই ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশের। আর ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বা ৩ হাজার ১৪৭ জন শিক্ষক স্নাতকই করেননি।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন ইংরেজির এক শিক্ষক বলেন, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করেছি। স্কুলে যোগদানের পর আমাকে ছোট ক্লাসগুলোর ইংরেজি পড়াতে বলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সব ক্লাসের ইংরেজির ক্লাস নেয়া শুরু করি। তিনি বলেন, এসএসসি পর্যায়ে পড়ানোর যে অভিজ্ঞতা তা হয়েছে। ইংরেজিতে পড়ানোর কারণে টিউশনির একটা বিষয় আছে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত একটা আয় হয় বলে যোগ করেন।
ফল বিপর্যয়ের এ ছাড়াও কারণ রয়েছে দু’টি। এই শিক্ষার্থীরা করোনার কারণে নানাভাবে পিছিয়ে যায়। ২০২০ সালে এই শিক্ষার্থীরা ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আর একটি বড় কারণ খাতা দেখায় কড়াকড়ি। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, এবার শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত বা গ্রেস মার্ক পায়নি।
রাজধানীর ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষক রুবাইয়া জাহান বলেন, পূর্বে আমাদের নির্দেশনা দেয়া হতো যাতে শিক্ষার্থীদের মার্ক বেশি করে দেয়া হয়। আবার নৈর্ব্যত্তিক, লিখিত ও ব্যবহারিক মিলিয়ে যোগ করার পর আমরা ২৭/২৮ পেলেও পাস মার্ক ৩৩ দিয়ে দিতাম। ওদিকে ৭৬ নম্বর পর্যন্ত পেলে ৮০ করে দেয়া হতো। সেইসঙ্গে নম্বর দেবার ক্ষেত্রে কৃপণতা করতাম না। নম্বর কমিয়ে দিলে পূর্বে জবাবদিহিতাও করতে হতো। এবার আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে প্রকৃত নম্বর যাতে দেয়া হয়। যার কারণে আমরা এবার প্রকৃত অর্থেই খাতা দেখেছি। প্রকৃত নম্বর দিয়েছি।
কিন্তু এবার প্রশ্ন উঠছে এই দায়টা কার? কেন ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী ফেল করলো? শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক সংকট ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবেই এই ফল বিপর্যয়। আওয়ামী লীগ আমলে ফল কৃত্রিমভাবে ভালো দেখানো হতো। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে ছিল না তাদের নজর। ৩৩ হাজারের কিছু বেশি বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯৬ হাজারের বেশি এন্ট্রি লেভেলের সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকরা যোগদানের পরও ৭৫ হাজার পদ খালি। সেইসঙ্গে যুক্ত হবে নতুন করে খালি হওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা। তিন বছরে কয়েক হাজার শিক্ষকের শূন্যপদ সৃষ্টি হবে তা অনুমেয়। ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। কারণ, পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির প্রায় ৯৭ হাজার পদের মধ্যে মাত্র সাড়ে ১৯ হাজার পদ পূরণ হয়েছে। আরও ৭৭ হাজার ৫০০ পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছর অবসরের কারণে শূন্য হয়েছে আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার পদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, এখানে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক ছিল না। যার কারণে নেতিবাচক প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগ আমলে বাড়তি একটা চাপ ছিল পাসের হার ও জিপিএ-৫ বাড়ানো। এটাকে বিগত দিনে শিক্ষার উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হয়েছিল। শিক্ষক নিয়োগ, মান উন্নয়ন ইত্যাদি ছিল গৌন। এসবের কারণে শিক্ষার মানে উন্নয়ন তো হয়নি বরং নেমে গিয়েছে। তিনি বলেন, এখন উচিত ফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।