Image description

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে আমি পত্রিকায় একটি লিখা দিয়েছিলাম "প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অনুরোধ করছি, সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে" শিরোনামে।

আজ আবার অনেকটা ওই লেখার মূলভাব নিয়েই লিখছি। আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছর উদযাপন করছি অথচ মানুষের মৌলিক মানবীয় চাহিদা হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপদ পানি,পয়ঃনিস্কাশন ইত্যাদির সুনিশ্চয়তা অভাব থেকে এখনও বের হতে পারিনি। বিশেষ করে অসুস্থ হলে, নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সময়োপযোগী, সঠিক ও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া মানুষের স্বাভাবিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শুধু আমাদের সংবিধান নয় বরং Universal Declaration of Human Rights এর ২৫ নন্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে আমাদের মৌলিক অধিকার পূরণে রাষ্ট্র অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রত্যেকেরই নিজের এবং তার পরিবারের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণের সাথে মানসম্মত পরিমিত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে খাবার, পোশাক, আবাসন এবং চিকিৎসা সেবা; বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা, বিধবাত্ব, বৃদ্ধ বয়স বা জীবিকার অভাব ইত্যাদি কারণে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সামাজিক সেবা ও নিরপত্তা প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। আর এই অধিকারের ক্ষেত্রে সবার থাকবে সমান অধিকার, যেখানে থাকবেনা কোন বৈষম্য, ধনী–দরিদ্রের পার্থক্য, সবাই পাবে সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা।যা এই Universal Declaration এর প্রথম অনুচ্ছেদে এমনটাই বলা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও আজ এটি চরম সত্যে পরিনত হয়েছে যে, কেবল তারাই চিকিৎসা পাচ্ছে যার অর্থ আছে, ক্ষমতা আছে, দাপট আছে; যার মামা, চাচা, খালু আর দুলাভাই আছে। যা খুবই দুঃখজনক, অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত, যা আমদের স্বাধীনতার মূল স্পিরিটেরও পরিপন্থি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে অর্ধ শতাব্দীরও উপর হতে চললো।

অথচ বাংলাদেশে কয়েকটি বড়ো বড়ো সমস্যা যেমন আবাসন সমস্যা, বিদ্যুতের সমস্যা, গ্যাসের সমস্যা, নিরাপদ পানির সমস্যা, সবার জন্য সার্বজনীন শিক্ষা সমস্যা, বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতার সমস্যা, ট্রাফিক সমস্যা, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণসহ আরও কয়েকটি, যার তালিকার অন্যতম হল চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা। একেকটি নির্বাচিত সরকার যদি তাঁদের প্রতিটি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা কালীন সময়ে কমপক্ষে একটি করে সমস্যার সমাধান করতেন, তাহলে কিন্তু বাংলাদশে আমি মনে করি চিকৎসা ব্যবস্থা সমস্যার মতো অতিবড় সমস্যাটি আজ একেবারেই থাকতো না। আপনাদের নিশ্চয়ই মাহাথির মোহাম্মদ, মালয়েশিয়ার কিংবদন্তি ও সফল প্রধানমন্ত্রীর নাম মনে আছে। তিনি সেই দেশের শিক্ষা, অর্থনীতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বৈপ্লবিক ও ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে একবার হার্টের সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরিষদ তাকে পার্শ্ববর্তীদেশ সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করতে অনুরোধ করলে তিনি তাদেরকে সাফ জানিয়ে দেন যে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাবেন না, কারণ তার দেশের সকল নাগরিক সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেন না। অন্য দেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া কে তিনি মনে করেছেন নিজের দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাকে ভিনদেশীদের সামনে তুলে ধরা যা একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খুবই অপমানজনক।তাই তিনি যাবেন না বরং তিনি মনোনিবেশ করলেন মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার কিভাবে উন্নতি সাধন করা যায় সেই দিকে।

যেই কথা সেই কাজ। মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়ে গেলো।দেশপ্রেম আর জনগণের প্রতি অঙ্গীকার কাকে বলে, তা শিখতে হবে মাহাথিরের কাছ থেকে। একজন মাহাথির আজ বাংলাদেশে খুব বেশী প্রয়োজন। আমাদের দেশের সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও একবার বলেছিলেন-“আমি যদি কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে আপনারা আমাকে বিদেশে নেবেন না। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাবেন না। আমি দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব। দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নেব।” তিনি মরে গেলেও বিদেশে চিকিৎসা করতে যাবেন না। তিনি তার সেই কথা রাখতে পারেন নি।সামান্য দাঁতের চিকিৎসা করাতেও তিনি লন্ডনে দৌড়ে এসেছিলেন।সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ চোখের চিকিৎসা ও ফলো আপ করানোর জন্য বছরে দু-তিন বার জার্মানি ও লন্ডনে পাড়ি জমাতেন। এই বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, এমপিরা বিদেশে গিয়ে এইরকমভাবে চিকিৎসা নেয় তা আমার চোখে পড়েনি। আর বর্তমান রাষ্ট্রপতি, বিরোদলীয় নেতা-নেত্রীরা কিছু দিন পর পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড দিতেন দৌড়।

সাবেক প্রধান্মপন্থী বেগম খালেদা জিয়াও চিকিৎসার জন্য আসতেন লন্ডনে, এবারও আসছেন। বাংলাদেশের চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, অনগ্রসর ও কম সুবিধা প্রাপ্ত দেশ যেমন নেপাল, ভূটান, ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা ভিন দেশে দাঁত, কান, গলা ও চোখের চিকিৎসা করাতে যাননা। তারা এটি বিশ্বাস করেন যে বিদেশে চিকিৎসা করার অর্থ হল নিজের দেশের স্বাস্থ্য খাতের অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করা, তারা মনে করেন এটি দেশের জন্য অসম্মানের।বরং তারা দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করে হাসপাতাল গড়ে তুলে সেখানেই চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার চিকিৎসা সেবার কথা নাই বা বললাম। বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে কি পরিমান অর্থ বিদেশে চলে যায় তা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশীরা বিদেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে যা বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪ শতাংশ। একটি উদাহরন দেয়া যাক, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী নাগরিককে ভারতে যাওয়ার মেডিক্যাল ভিসা দিয়েছে তারা।

এ সংখ্যা ২০১৬ সালে ভারতগামী চিকিৎসা প্রার্থীদের তুলনায় দ্বিগুণ। একই বছরে থাইল্যান্ডে গিয়েছে প্রায় ৬৫০০০, আর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল তো খরচের দিক দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে, তাতেও বাংলাদেশ থেকে সেখানে চিকিৎসা নিতে যাওয়া লোকের অভাব নেই। মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব সহজেই নাগরিকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া সম্ভব, দরকার শুধু উদ্যোগের, মানসিকতার ও সিদ্ধান্তের। বাংলাদেশে অনেক বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা যদি একটু চিন্তা করে আর সরকার তাদেরকে একটু উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়, তাহলে বিশ্বাস করুন আমাদের দেশের শিল্পপতিরাও অনেক উন্নতমানের আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তুলতে সক্ষম। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে যদি বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে একটিকরে ভালোমানের আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা সেবা সম্বলিত একটি করে হাসপাতাল গড়ে তোলা যেত এবং চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রিকরণ করা যেত, তাহলে বাংলাদেশ থেকে এই বিশাল অংকের টাকা বিদেশে যেত না। দেশের টাকা দেশেই থাকতো। পরিশেষে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপনাকে বলছি, আপনাকে জাতি আপোষহীন নেত্রী হিসেবেই চিনে ও জানে।

দেশবাসী আশা করবে আপনিও চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে আপোষহীন ভূমিকা রাখবেন। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে আপনারা যদি সরকার গঠন করেন তাহলে আপনি অন্তত দেশে চিকিৎসার মানোন্নয়নের জন্য ভূমিকা রাখবেন, শিল্পপতিদেরকে ডেকে নিয়ে একেকটি বিভাগে অন্তত একটি করে আধুনিক ও উন্নমানের হাসপাতাল গড়তে নির্দেশনা দিবেন যাতে দেশের আপামর জনগণের নিকট উন্নত চিকিৎসা সেবা পৌঁছে যায় এবং পাশাপাশি চিকিৎসার নামে দেশের অর্থ বিদেশে না যায়।

ব্যারিষ্টার ওয়াহিদ মুহাম্মদ মাহবুব - লন্ডন।