
Md Saidul Islam (ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম)
এসোসিয়েট প্রফেসর, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
নানইয়াং টেকনোলোজিকাল ইউনিভার্সিটি সিংগাপুর
আসসালামু আলাইকুম। আমার এই লেখাটা পড়ে হয়তো বিএনপির অনেকেই আমার প্রতি প্রচন্ডরকম ক্ষেপে যেতে পারেন। তবে সমাজবিজ্ঞানের একজন ক্ষুদ্র ছাত্র হিসাবে বিএনপি এবং দেশের জন্য যেটাকে মঙ্গলজনক মনে করেছি, সেটাই লিখেছি। পড়ে দেখতে পারেন। কিঞ্চিৎ অশ্লীলতার জন্য দু:খিত।
===================================
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূদৃশ্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং বর্তমানে এক নতুন মেরুকরণ ও দ্বিধাবিভক্তির স্পষ্ট রূপরেখা ফুটে উঠছে। এই দ্বিধাবিভক্তি কেবল আদর্শগত নয়, বরং ভূরাজনৈতিক আনুগত্য, রাজনৈতিক কৌশল, এবং জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে।
একদিকে আছে ভারতীয় লবি, হানিট্র্যাপে আটকে পড়া রাজনীতিবিদ, কর্পোরেট পুঁজির প্রভাবে পরিচালিত সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক ফ্যাসিস্ট-সমর্থিত ধনিকচক্রের ছত্রছায়ায় থাকা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও তথাকথিত বামপন্থীরা। অন্যদিকে, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত নতুন প্রজন্ম এবং ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের আত্মত্যাগকে ধারণকারী জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, এনসিপি, এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী ও দেশপ্রেমিক দলসমূহ।
এই মেরুকরণ একদিক থেকে রাজনৈতিক পরিশোধনের (political distillation) কাজ করছে। এখন আর আদর্শহীন “মধ্যপন্থা” দিয়ে চলা যাবে না—প্রত্যেক দল ও নেতাকে জনগণ জিজ্ঞেস করবে, আপনি কার পক্ষে: বাংলাদেশের পক্ষে, না ভারতের পক্ষে? গণতন্ত্রের পক্ষে, না ফ্যাসিবাদের পক্ষে? শহীদের রক্তের পক্ষে, না নির্যাতকের সঙ্গী?
বিএনপির দুঃখজনক রূপান্তর: এক আত্মবিধ্বংসী সমঝোতা:
বিএনপির সাম্প্রতিক অবস্থান এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সম্ভাব্য সমঝোতা এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর হতাশাজনক পালা। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে এবং জামায়াতসহ ইসলামী দলসমূহকে কোনোভাবেই ক্ষমতার কাছাকাছি না আসতে দেওয়ার শর্তে যে সমঝোতা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত।
যদিও আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ, তথাপি বিএনপির কাঁধে চড়ে তাদের রাজনীতিতে ফেরার আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছর পরিশ্রান্ত বিএনপির একাংশ ভারতের সমর্থন, আওয়ামী লীগ থেকে আসা ভোট, ফ্যাসিস্ট ফান্ড এবং তাৎক্ষণিক ক্ষমতা লাভের লোভ সামলাতে পারছে না। কিন্তু এই সমঝোতা তাদের জন্য এক আত্মঘাতী চুক্তি, যার চূড়ান্ত পরিণতি হতে পারে বিএনপির "অপমৃত্যু"—একটি রাজনৈতিক শক্তির নৈতিক, আদর্শিক ও জনপ্রিয়তাগত মৃত্যু।
অ্যানিচিনাস এবং বিএনপি: আত্মবিধ্বংসী মোহের ফাঁদ:
বিএনপির বর্তমান অবস্থানকে বোঝাতে আমরা একটি বিশেষ প্রাণীর আচরণগত বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করতে পারি—অস্ট্রেলিয়ান অ্যানিচিনাস (Antechinus)। এটি মারসুপিয়াল গোত্রের একটি ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রতি বছর ব্রিডিং সিজনে পুরুষ অ্যানিচিনাসরা প্রবল যৌন-আকাঙ্ক্ষায় এমনভাবে নিমগ্ন হয় যে খাওয়া-ঘুম-আত্মরক্ষা ভুলে গিয়ে একটানা সঙ্গমে লিপ্ত থাকে ১২–১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। ফলস্বরূপ, শরীরে কর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের মাত্রাতিরিক্ত স্রাব হয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বংস হয়ে যায়। অধিকাংশ পুরুষ প্রজনন পর্ব শেষেই মারা যায়—যৌনতার মোহে মৃত্যু।
এই আচরণকে বলা হয় "Sex-Death Fallacy"—অর্থাৎ এমন এক আত্মঘাতী মোহ, যা নিশ্চিত ধ্বংসের পথ জেনেও মানুষ বা প্রাণী নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। এই ফ্যালাসি হলো বাস্তব জীবনের একটি চমৎকার উদাহরণ, যেখানে অতিরিক্ত মোহ প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। অ্যানিচিনাস জানে যে এই মোহ হয়তো তাকে মৃত্যু ঘটাবে, কিন্তু লোভ এবং মোহ তাকে এতোটাই অন্ধ করে ফেলে এবং নিজের নিয়ন্ত্রণ শক্তিকে এতোটাই দুর্বল করে ফেলে যে নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও সে এটা থেকে ফিরতে পারে না। আওয়ামী লীগও তাদের লোভ-লালসায় "পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন" চলে এসেছিল, এবং নির্ঘাত রাজনৈতিক মৃত্যুকে আলিংগন করতে বাধ্য হয়েছে।
বিএনপিও যেন সেই মোহে আটকে পড়েছে—যেখানে সাময়িক ক্ষমতার হাতছানি, ভারতের আশ্বাস, এবং আওয়ামী লীগের ফাঁদ তাদের এমন এক পথে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে নৈতিক মৃত্যু অনিবার্য। বিএনপি নিজেই জানে যে এই পথ বিপজ্জনক, কিন্তু কিছু লোভী নেতার কারণে তারা আর ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
জুলাই বিপ্লবের বার্তা ও বিএনপির বাস্তবতা:
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব আমাদের স্পষ্ট করে দিয়েছে: বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আর ভারতের আধিপত্য ও দাসত্বের রাজনীতি মানে না। তারা দলীয় দুর্বৃত্তায়ন, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এই বিপ্লব প্রমাণ করেছে, জনগণ পরিবর্তন চায়—আদর্শিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক। এই বিপ্লবের মধ্যে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা নিহিত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপির তৃণমূলের বিশাল একটি অংশ এখনও এই আদর্শে বিশ্বাস করে। কিন্তু যদি তাদের নেতৃত্ব এভাবে আত্মঘাতী মোহে পড়ে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গী হয়ে ওঠে, তবে বিএনপির অপমৃত্যুকে ঠেকানো দুঃসাধ্য হবে না।
বিএনপির ভবিষ্যতের জন্য ১০টি পরামর্শ:
জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি শক্তির ঐক্য এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান—এই দুই মৌলিক রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তির ওপরই বিএনপির পরিচয় ও শক্তি প্রতিষ্ঠিত। মেজর জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির মূল দর্শন ছিল এই দুই শক্তির সমন্বয়। এই আদর্শই দলটিকে এক সময় ব্যাপক জনসমর্থন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিল।
যদি বিএনপি এই আদর্শিক ভিত্তি থেকে সরে আসে কিংবা তা হারিয়ে ফেলে, তাহলে দলটির আদর্শিক পতন শুধু অনিবার্যই নয়, বরং এটি তার অস্তিত্ব সংকটের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে দেশে একটি নতুন প্রজন্মের ফ্যাসিবাদ শক্তির উত্থানও
রুদ্ধহীন হয়ে উঠবে। বিএনপির ভবিষ্যতের সুরক্ষা ও পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে আমার দশটি পরামর্শ নিচে তুলে ধরা হলো:
১. ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধিতা: কোনো পরিস্থিতিতেই ভারতের প্রভাবাধীন রাজনীতির সহযাত্রী হওয়া যাবে না। জনগণ উপনিবেশবিরোধী রাজনীতি চায়।
২. আদর্শিক শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনুন: বিএনপি তার আদর্শিক ভিত্তি ও ৭০/৯০ দশকের গণতান্ত্রিক চেতনায় ফিরুক।
৩. জুলাই বিপ্লবের সাথে সংযোগ: বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সংলাপে বসে তাদের নেতৃত্ব ও আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি দিন।
৪. জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর প্রতি বৈরিতা বন্ধ করুন: বিরোধী রাজনীতিতে ইসলামী শক্তিকে বাদ দিয়ে সত্যিকারের জাতীয় ঐক্য গঠন অসম্ভব।
৫. স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব নির্বাচিত করুন: পরিবারতন্ত্র, সুবিধাবাদ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব থেকে বের হয়ে তরুণ ও জনভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুলুন। ৬. অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক জোট গঠন করুন: ধর্মভিত্তিক, আদর্শিক ও ভিন্নমতাবলম্বী দলগুলোর সঙ্গে কার্যকরী জোট গড়ে তুলুন।
৭. আন্তর্জাতিক মেরুকরণে সতর্ক থাকুন: ফ্যাসিবাদ-সমর্থক দেশ বা গোষ্ঠীর প্ররোচনায় না পড়ে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিন।
৮. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে তুলুন: নতুন রাজনৈতিক কর্মী তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্য পার্টি স্কুল চালু করুন।
৯. জনতার দাবি ও আন্দোলনের প্রতি সংবেদনশীল হোন: শুধু নির্বাচন নয়, ন্যায়ের পক্ষে জনআন্দোলনের প্রতি সক্রিয় অংশগ্রহণ বজায় রাখুন।
১০. বিএনপিকে পুনঃজাগরণের পথে নিয়ে যান: রাজনৈতিক আত্মহত্যার পথ ছেড়ে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিএনপিকে এক নতুন পথ দেখান।