
ভোটার তালিকার কাজের সুবিধার্থে ২০১২ সালে ৮০ হাজার ব্যাগ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মরহুম ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু নিম্নমানের ব্যাগ স্লাপাই দিয়ে ফেঁসে যায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
এ ব্যাগ কেলেঙ্কারি ঢাকতে ভাড়া গুদামে ব্যাগগুলো রাখা হয়। প্রতি মাসে এর পেছনে ইসির খরচ হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত ১৪৪ মাসে গচ্চা কোটি টাকার উপরে। সূত্র জানায়, ওই সময়ে ঘটনাটি ছিল ‘টক অব দ্য ইসি’।
ইসির সূত্র মতে, এই মানহীন ব্যাগ গ্রহণ না করার সুপারিশ ছিল যাচাই-বাছাই কমিটির। কিন্তু সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এ টি এম শামসুল হুদা এগুলোকে নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ না করার নির্দেশ দেন। ফলে সবাই চুপ হয়ে যান। গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী পুনর্গঠিত কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পুরোনো অনিয়মগুলো সামনে চলে আসে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এই ইস্যুতে তৎপর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ অনিয়মের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বিগত কমিশনগুলোর। কারণ, বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে জিইয়ে রেখেছিলেন তারাও। বলা যায়, একযুগ আগের দুর্নীতির রেশ এখনো শেষই হচ্ছে না। বর্তমান কমিশন উদ্যোগ নিলেও তা সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এক-এগারোর ড. হুদা কমিশনের দুর্নীতির দায় বর্তেছে এএএম নাসিরউদ্দিনের কাঁধে।
ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ইসির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ (এসইএমবি) প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে সুচারু ও সুন্দরভাবে কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজারদের জন্য কিছু সামগ্রী কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল ইসি। এসইএমবি প্রকল্পের নিয়োগপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ পদধারী সবাই ছিলেন ড. হুদার আত্মীয়-স্বজন। ফলে ভোটার তালিকার সরঞ্জাম যেমন ল্যাপটপ, স্ক্যানার, পাওয়ার পয়েন্ট ও চার্জারসহ ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসগুলো সংরক্ষণ ও বহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ৮০ হাজার উন্নত মানের ব্যাগ কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রথম চালানে ১০ হাজার ব্যাগ সরবরাহ করে।
সূত্র জানায়, ব্যাগগুলো মানহীন ও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ইসির তৎকালীন গুণগতমান যাচাই-বাছাই কমিটি সেগুলো গ্রহণ করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৫ মে দুদক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর (ডিএমপি) থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ইসি সচিবালয়ের স্টোররুমে জায়গা না হওয়ায় কথিত ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ আগারগাঁওয়ের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৯০৫ ও ৯০৮ নম্বর কক্ষ ভাড়া নিয়ে ওই ব্যাগগুলো সিলগালা করে সংরক্ষণে রাখা হয়।
সূত্র বলছে, চলতি বছরের শুরুতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দাপ্তরিক কাজের জন্য অতিরিক্ত জায়গার প্রয়োজন হওয়ায় ভাড়া জায়গা খালি করার জন্য ইসিকে অনুরোধ জানায়। তারপর দুর্নীতির মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ায় তোড়জোড় শুরু হয়।
এদিকে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত তদন্ত ছাড়াই দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর এই ইস্যুটি ধামাচাপা পড়েছিল। তদন্তে মামলার অগ্রগতিও ছিল না। নতুন এএমএম নাসিরউদ্দিনের কমিশন গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত হাসিনা সরকারের একের পর এক দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। নিম্নমানের ব্যাগ কেলেঙ্কারির পাশাপাশি স্মার্টকার্ড প্রকল্পে দুর্নীতি, ইভিএম প্রকল্পে অনিয়ম ও অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা-সংক্রান্ত অ্যাপ তৈরি তহবিল তছরুপের ঘটনা ঘটেছে।
ব্যাগ কেলেঙ্কারির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আক্তার আহমেদ আমার দেশকে জানান, ভোটার তালিকার জন্য ৮০ হাজার ব্যাগ কেনার সিদ্ধান্ত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী ব্যাগ কেনা হয়। চাহিদার একটি চালান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছিল। কিন্তু নিম্নমানের ছিল বিধায় দুদকে একটি মামলা হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির জন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সূত্র জানায়, এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের সময় থেকে ইসিতে আত্মীয়করণ চলছে। এর মধ্যে ছিলেন সাবেক সিইসি মরহুম ড. শামসুল হুদার আত্মীয় এবং সাবেক এনআইডির ডিজি ও নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে (অব.) শাহাদাত হোসেন, হুদার আত্মীয় ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবদুল আলীম ও আব্দুল রহিম খান, শেখ রেহানার দেবর ও শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকের ভাগনে ও সাবেক এনআইডির ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন এবং সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ভাগনে সাবেক এনআইডির ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) সাইদুল ইসলাম।
জানতে চাইলে ব্যাগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ড. আবদুল আলীম আমার দেশকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে এটির কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কারণ আমি ইউএনডিপির সঙ্গে কাজ করতাম। আর ব্যাগ কেনা হয় ইসির পক্ষ থেকে। অনিয়মের কারণে একটা মামলা হয়েছিল। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’