Image description

খুলনার বটিয়াঘাটার একটি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৭৫০ মিটার হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) রাস্তা নিম্নমানের ইট, ও বালুর স্তর কম থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকাবাসী সুফল না পেয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি তুলেছে। টেকসই গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ার লক্ষ্য নিয়ে নেওয়া প্রকল্পটি নির্মাণ ত্রুটির কারণে এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

টেকসই গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও কাদামাটির সড়ক থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে মুক্তি দিতে ‘গ্রামীণ মাটির রাস্তাসমূহ টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) করণ’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী এইচবিবি সড়ক নির্মাণে গ্রেড-১ ইট অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হলেও প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে নির্মিত রাস্তায় ২০ শতাংশ স্থানে নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক স্থানে ইটও কম ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তত ২০ শতাংশ স্থানে ইটের নিচে বালুর স্তর কম থাকায় মসৃণতা হারিয়েছে রাস্তা। আইএমইডির পর্যক্ষেণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে ইট-বালুতে ফাঁকি, প্রশ্নবিদ্ধ কাজ

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, দেশের ৪৯৪টি উপজেলায় প্রকল্পে মোট চার হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও সঠিক সুফল পায়নি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। প্রকল্পের আওতায় ছয় হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার মাটির রাস্তা এইচবিবিকরণ করা হয়েছে। মেয়াদ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২৫ নাগাদ।

 

আইএমইডি প্রতিবেদন হাতে এসেছে। কিন্তু এখনো খুলে দেখা হয়নি। আমরা বছর বছর গ্রামীণ সড়ক এইচবিবিকরণ করি। সড়ক নির্মাণে কোথাও ব্যত্যয় দেখলে আমরা দেখে ব্যবস্থা নেবো। আমরা চাই কাজের মান ভালো হোক। আইএমইডি প্রতিবেদনে কোথাও কাজের গ্যাপ থাকলে তা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেবো।- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান

আই্এমইডি জানায়, প্রকল্পটি জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে গ্রহণ করা হয়, যা ৪ নভেম্বর ২০১৮ সালে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। করোনা মহামারির অভিঘাত, স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নে সাময়িক বিলম্বসহ বিবিধ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে এক বছর বাড়িয়ে ৩০ জুন ২০২৩ করা হয়। স্থানীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষঙ্গিক কাজ বাড়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ৩০ জুন ২০২৫ করা হয় এবং দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপি একনেকে অনুমোদিত হয়।

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ক্রয়-ক্ষমতা বাড়িয়ে সামগ্রিক দারিদ্র্য হ্রাস, গ্রামীণ মাটির রাস্তা দীর্ঘস্থায়ী-টেকসই করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ সহজ করা। প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি তথ্য উৎস ব্যবহার করে গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে। পরিমাণগত পদ্ধতিতে ৮শ সুবিধাভোগী নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। গুণগত পদ্ধতিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সম্ভাব্য সুবিধাভোগী ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আট দলীয় আলোচনা এবং ৩৫টি নিবিড় সাক্ষাৎকার পরিচালনা করা হয়েছে।

গ্রামীণ সড়ক হেরিং বোন বন্ডে নিম্নমানের ইট ও বালু কম দেওয়া প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইএমইডি প্রতিবেদন হাতে এসেছে। কিন্তু এখনো খুলে দেখা হয়নি। আমরা বছর বছর গ্রামীণ সড়ক এইচবিবিকরণ করি। সড়ক নির্মাণে কোথাও ব্যত্যয় দেখলে আমরা দেখে ব্যবস্থা নেবো। আমরা চাই কাজের মান ভালো হোক। আইএমইডি প্রতিবেদনে কোথাও কাজের গ্যাপ থাকলে তা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

 

গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে ইট-বালুতে ফাঁকি, প্রশ্নবিদ্ধ কাজ

আইএমইডি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাস্তা এইচবিবিকরণে প্রস্থ ৩ মিটার ভেরিয়েবল থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে প্রস্থ ৩ মিটারের কম অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হয়েছে। এইচবিবিকরণের আগে রাস্তার সাবগ্রেড কম্পিটিশন যথাযথ না হওয়ায় অন্তত শতকরা ১০ শতাংশ স্থানে আংশিক মাটি দেবে গেছে। প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি না হওয়া এবং প্রকল্পের এক্সিট পরিকল্পনাও নেই। নির্মিত রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণর দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে।

২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৩৫টি জেলায় মোট ৩৬২টি আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, যা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

আমরা প্রকল্পগুলো তদারকি করছি। কিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। যেখানে গ্যাপ আছে সেটা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। এতে প্রকল্পের সঠিক সুফল পাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী।- আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন

এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পগুলো তদারকি করছি। কিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। তার মধ্যে অন্যতম গ্রামীণ মাটির রাস্তাসমূহ টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বোন বন্ডকরণ প্রকল্প। প্রকল্পের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রকল্প পরিচালককে দেওয়া হয়েছে। যেখানে গ্যাপ আছে সেটা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। এতে প্রকল্পের সঠিক সুফল পাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী।’

জানা যায়, সেকেন্ডারি তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রকল্পের সামগ্রিক তথ্য, উপাদান, ডিপিপি, প্রতিবেদনসহ ফলাফল বিষয়ক প্রাসঙ্গিক দলিলাদি পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে আটটি বিভাগ থেকে একটি করে আটটি কেস স্ট্যাডি করা হয়েছে এবং প্রাপ্ত ফলাফল প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে। মার্চ, ২০২৫ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৮৯ দশমিক ০২ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

এইচবিবিকরণ কাজের দর তফসিল পরিবর্তন ও মাঠ পর্যায়ে চাহিদা এবং প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত ১২শ কিমি রাস্তা নির্মাণ পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ডিপিপি দ্বিতীয়বার সংশোধন করা হয়। পুকুর, খাল বা নদী তীরবর্তী এলাকার ঢালের গাইডওয়াল, প্রতিরক্ষা দেওয়াল ও প্যালাসাইডিং স্থানীয় চাহিদার তুলনায় কম হয়েছে।

প্রকল্পের বিষয়ে আরও কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আইএমইডি। প্রকল্পের বাস্তবায়নে রাস্তার উন্নতি হওয়ায় অতিরিক্ত ভারী যানবাহন, ট্রাক্টর, মালবাহী গাড়ি চলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে রাস্তা দীর্ঘস্থায়ী করতে সড়ক প্রশস্ত ও আরসিসিকরণে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। গ্রামীণ রাস্তা এইচবিবিকরণের গুরুত্ব পর্যালোচনা করে বিস্তারিত মাস্টার প্ল্যান তৈরি/আপডেট করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। অডিট আপত্তিগুলো উপজেলা পর্যায় থেকে প্রকল্প পরিচালক অফিসে দ্রুত পাঠাতে হবে যেন তা সংরক্ষণ ও নিষ্পত্তীকরণ সহজ হয়।