Image description

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও অন্যান্য রফতানি পণ্যের ওপর আরোপিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহারের লক্ষ্যে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের প্রথম দফার বৈঠক কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে।

তবে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ ছিল ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ’ এবং ‘ইতিবাচক’, এমনটাই দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আলোচনার দ্বিতীয় দফা বসছে আগামী ৮ জুলাই, যেখানে চূড়ান্ত সময়সীমার মাত্র একদিন আগে আবারও মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র।

এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে দেশে রফতানিমুখী শিল্প বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বিষয়টিকে “গার্মেন্ট খাতের জন্য বড় হুমকি” বলে অভিহিত করেছে।

আলোচনার পটভূমি: ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক’ ঘোষণা

২০২৫ সালের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর অজুহাতে বেশ কয়েকটি দেশের রফতানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন। এর আওতায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হয়, ফলে মোট শুল্কহার দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তীব্র কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানানো হলে ৯ এপ্রিল তিন মাসের জন্য শুল্ক কার্যকারিতা স্থগিত রাখা হয়। সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৯ জুলাই। এর আগেই একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে উভয়পক্ষ রাজি হয়, যার আলোকে শুরু হয় আলোচনা।

বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর (যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়)-এ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম দফার আলোচনার আনুষ্ঠানিক বৈঠক।

বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) ব্রেন্ডান লিঞ্চ।

মূল অচলাবস্থার কারণ: তিনটি কঠিন শর্ত

সূত্রগুলো বলছে, আলোচনায় অগ্রগতি থাকলেও তিনটি মূল বিষয়ে এখনও মতপার্থক্য রয়ে গেছে:

১. রুলস অব অরিজিন (RoO):

যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ তার রফতানি পণ্যে আঞ্চলিক মূল্য সংযোজন (Regional Value Addition) নিশ্চিত করুক, অর্থাৎ কাঁচামালের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাধ্যমে আসতে হবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ বর্তমানে ঘরোয়া মূল্য সংযোজন (Domestic Value Addition) প্রক্রিয়ায় কাজ করে, যা স্থানীয় উৎপাদকদের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা স্থানীয় ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছে ঢাকা।

২. ভূ-রাজনৈতিক সঙ্গতি বা জিও-পলিটিক্যাল অ্যালাইনমেন্ট:

যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া অনুযায়ী, কোনও দেশের ওপর যদি তারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে বাংলাদেশকেও সেই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে।

চীন, রাশিয়া ও ইরানের মতো যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তাদের ওপর এমন শর্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে।

৩. শুল্ক পারস্পরিকতা ও এমএফএন (Most Favored Nation) লঙ্ঘনের অভিযোগ:

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা যেসব পণ্যে বাংলাদেশকে শুল্ক ছাড় দেবে, বাংলাদেশ যেন সেই পণ্য অন্য কোনও দেশকে ছাড় না দেয়।

বাংলাদেশ বলছে, এই শর্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, ব্যাংক সুদের ঊর্ধ্বগতি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ–এর বারবার মূল্যবৃদ্ধি—এইসব মিলিয়ে গার্মেন্ট খাত একাধিক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।” তিনি আরও বলেন, ইউএসটিআরের সঙ্গে পরবর্তী যে বৈঠক হবে এবং আমরা তাতে আশাবাদী যে চূড়ান্ত চুক্তির দিকে অগ্রগতি হবে।”

৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি না হলে কী হবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং আলোচনার সময়সীমা প্রয়োজনে বাড়াবে।”

বাংলাদেশের জোরালো কূটনীতি ও প্রস্তুতি

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে তিন দফা চুক্তির খসড়া বিনিময় হয়েছে, চারটি বৈঠক হয়েছে, এবং ২৯ বার বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মতো এত ঘন ঘন যোগাযোগ অন্য কোনও দেশ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা চাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় থাকুক এবং কোনোভাবেই অতিরিক্ত শুল্ক যেন আরোপ না হয়।”

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও চুক্তির সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যেখানে তারা ভিয়েতনামি পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে, কিন্তু ভিয়েতনাম মার্কিন পণ্যে শূন্য শুল্ক দেবে।

অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া কঠিন শর্তের কারণে আলোচনা থেকে সরে গেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখনও একমাত্র বাংলাদেশই আলোচনা টিকিয়ে রেখেছে।

সম্ভাব্য পরিণতি: শুল্ক কার্যকর হলে কী হবে?

বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। ৫৩ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে রফতানি কমে যাবে, বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে এবং লাখো শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য রফতানি বাজার ধরে রাখার কৌশল নির্ভর করবে কূটনৈতিক দক্ষতা, বাস্তবতাভিত্তিক ছাড় ও জাতীয় স্বার্থের ভারসাম্যের ওপর।

সমঝোতার আশাই ভরসা

আলোচনা চলমান থাকলে ৮ জুলাইয়ের পরেও শুল্ক কার্যকরের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে সময় খুব সীমিত। একদিন পরই শেষ হচ্ছে স্থগিতাদেশের মেয়াদ।

এই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন ও সচিব মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে আগামী ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় বৈঠকটি হয়ে উঠছে ‘ফাইনাল রাউন্ড’।

বাংলাদেশ সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বাস্তবতা বুঝবে এবং একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছানো যাবে। তবে না হলেও আমরা প্রস্তুত—অর্থনৈতিক কৌশলে বিকল্প পথ খোঁজা হচ্ছে।”