
দেশে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতি চালু হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বাইরে স্বতন্ত্র কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। কারণ এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে নয়, ভোট দিতে হবে দলকে। পিআর পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে চলমান আলোচনার মধ্যে এ তথ্যটি স্পষ্ট করেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দুজন সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ও ড. মো. আবদুল আলীম। কালের কণ্ঠকে তাঁরা বলেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দলের জন্য প্রযোজ্য।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দেশের আগের সব সংসদ নির্বাচনেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে আসন লাভ করেন।
প্রতিবেদনে পিআর পদ্ধতির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে এই মর্মে বলা হয়েছে যে এর ‘একটি বড় দুর্বলতা হলো সরকারের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা’। বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার এবং সে অনুসারে পিআর পদ্ধতিতে বণ্টনযোগ্য আসনসংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে উল্লিখিত চারটি নির্বাচনে যেহেতু কোনো দলের পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো না, তাই বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যেতে পারত এবং ‘টিরানি অব দ্য স্মল মাইনরিটি’ বা ছোটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারত। এ ছাড়া সরকার গঠনে ভাঙাগড়ার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে পারত।
‘ছোটদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা’র নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলের কথা উল্লেখ করে কমিশনের প্রতিবেদনের ফুটনোটে বলা হয়েছে, ‘এ প্রসঙ্গে গাজায় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের উদাহরণ টানা যেতে পারে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, গাজায় যুদ্ধ এত প্রলম্বিত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কারণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কিছু অতি ক্ষুদ্র উগ্র ধর্মান্ধ দলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন।’
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির আরো অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় উঠে এসেছে। মতবিনিময়ের সময় একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে, অনেক ব্যক্তি ও দল যারা নীতিগতভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, তাদের অনেকেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটির প্রবর্তনের বিপক্ষে। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান সময়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হলে বিতাড়িত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের আশঙ্কা দেখা দেবে।’
সংস্কার কমিশন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নেতিবাচক দিকের উদাহরণ দিতে গিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকশিত একটি প্রতিবেদনের কথাও তুলে ধরে। ওই প্রতিবেদনে এই মর্মে বলা হয়েছে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থায় আরো স্বৈরাচারী হবেন দল ও দলপ্রধান। কারণ তখন সংসদ সদস্য হতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা আর জনগণের কাছে যাবেন না; যাবেন দলের নেতার কাছে। আগে থেকেই টাকা নিয়ে হাজির হবেন। দলের প্রধানরা মোটামুটি নিলামে তুলে প্রতিটি আসনের বিপরীতে টাকা নিয়ে নেবেন। তারপর সংসদ সদস্য নির্ধারণ করা হবে। বিষয়টি ঘটতে পারে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রের মতো। এ ছাড়া বর্তমান নির্বাচনী আসনব্যবস্থার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। রাতারাতি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের আগে এর ভালো-মন্দ, দেশের প্রেক্ষাপট সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই করা দরকার। এ পদ্ধতি চালু করা হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে। এর মোদ্দাকথা হলো, জনগণ কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীর পরিবর্তে দলীয় প্রতীকে ভোট দেবে। একটি দল শতকরা যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুসারে সংসদে আসন পাবে। অর্থাৎ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে সরকার গঠন করতে একটি দলকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে, যা হবে কঠিন। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা দেবে আরেক সমস্যা। যদি কোনো সরকারের ৫০ শতাংশের বেশি আসন না থাকে তাহলে দেখা যাবে, সরকার বাজেটসহ বিভিন্ন আইন পাস করতে পারছে না। আইন পাসের জন্য অন্য দলের শরণাপন্ন হতে হবে। সেসব দল সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেবে। উন্মোচিত হবে নতুন দুর্নীতির ক্ষেত্র। ছোট দলগুলো কারণে-অকারণে সরকারকে ফেলে দিতে চাইবে এবং কোনো সরকারই সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। বর্তমানে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ৩০০ সংসদ সদস্য নির্বাচনের যে বিধান রয়েছে, সেটির মাধ্যমে প্রতিটি আসনে মনোনয়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয় এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। কিছু নেতা তৈরি হয়। জনগণের ভোট পেতে হলে তাঁদের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশতে হয়। কথা বলতে হয়। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু হলে জনগণের কোনো সংসদ সদস্য থাকবে না। থাকবে দলীয় প্রধানের আনুগত্য, পোষা সংসদ সদস্য, যাঁদের আনুগত্য থাকবে কেবল দলীয় প্রধানের কাছে। সংসদ হবে দলীয় ক্লাব।
প্রতিবেদনে সংস্কার কমিশন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সমস্যা হিসেবে আরো উল্লেখ করেছে, ‘সংসদের আসনসংখ্যা ভাগ হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতের হারে। এ ব্যবস্থায় ভোটাররা ভোট প্রদান করেন রাজনৈতিক দলকে, কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয় এবং রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা নির্ভর করে দলের প্রাপ্ত ভোটের হারের ওপর। তবে কোনো আসন পেতে হলে দলকে ন্যূনতম হারের ভোট পেতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি সারা দেশে মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে সেই দল সংসদের মোট আসনের ৫ শতাংশ আসন পাবে। প্রসঙ্গত, সংসদীয় আসনের ভাগ পাওয়ার মানদণ্ড যদি ন্যূনতম ৫ শতাংশ হয়, তাহলে আমাদের দেশের ছোট ছোট দলগুলোর, যাদের প্রায় সবারই ভোটপ্রাপ্তির হার ৫ শতাংশের কম, তারা কোনো আসন পাবে না।’
সার্বিক এই পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের মূল্যায়ন, “এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমান আসনভিত্তিক ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ এফপিটিপি এবং সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। দুটি পদ্ধতিই বলতে গেলে ‘মিক্সড ব্লেসিং’ বা মিশ্র আশীর্বাদ। এ বিবেচনায় অনেক দেশেই এখন মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। মিশ্র পদ্ধতিতে সংসদের একাংশ এফপিটিপি পদ্ধতিতে, আরেকাংশ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে থাকে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিও বহু রকমের হয়ে থাকে। এ ছাড়া সংসদের দুই কক্ষে দুই ধরনের পদ্ধতিও থাকতে পারে।”
কমিশনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘এমনি প্রেক্ষাপটে অংশীজনের পক্ষ থেকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের পক্ষে-বিপক্ষে দাবি উঠেছে। তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় অনেক অংশীজন একটি মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। অনেকে আবার সংসদে উচ্চকক্ষ স্থাপিত হলে সেখানে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রচলনের দাবি তুলেছে। তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম মতবিরোধ রয়েছে।’
এ বিষয়ে কমিশনের পক্ষে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবের কারণে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে কোনোরূপ সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’