
গত বছরের জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তার সহপাঠীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলেন ১৯ বছরের শিক্ষার্থী রেদোয়ান শরীফ রিয়াদ। কিন্তু একটি বুলেটেই সব স্বপ্নের সমাপ্তি টেনে দেয় রাষ্ট্র। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে থেমে গেছে একটি পরিবারের ভবিষ্যতের পথচলা।
এখন বাবা-মা আর বড় বোন সিমু আহম্মেদ। রিয়াদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বুক চাপড়ে তিনি কেবল একটি কথাই বলেন— ‘রিয়াদ বাঁচলে বিসিএস ক্যাডার হতো সব স্বপ্ন এক নিমিষে শেষ।’
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের সন্তান রিয়াদ ছিলেন আহম্মদ উল্লাহ বাদল ও রুপালী আক্তার দম্পতির একমাত্র ছেলে। ঢাকার টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করতেন তিনি।
তার বড় বোন সিমু আহম্মেদ বলেন, ‘রিয়াদ ছোট থেকেই অনেক দায়িত্বশীল আর ম্যাচিউরড ছিল। বাবা-মায়ের সামর্থ্যের বাইরে কখনও কোনো আবদার করেনি। বিসিএস ক্যাডার হবার স্বপ্ন ছিল ওর। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে আমার ভাই আর নেই। আমাদের সব শান্তি, স্বপ্ন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে।’
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত রেদোয়ান শরীফ রিয়াদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে গড়ার জন্য নিজ জেলা ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় নিয়ে যায় তার মা-বাবা। ঢাকার উত্তরাতে একটি ভাড়া বাসায় মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন রিয়াদ। লেখাপড়ার পাশাপাশি খুব পছন্দ করতেন ক্রিকেট খেলা। তার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল, লেখাপড়া শেষ করে আয় করে বাবা-মা আর বোনের মুখে হাসি ফোটাবেন। কিন্তু গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে মাথায় বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রিয়াদ।
রিয়াদের মা বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে উঠে রিয়াদের বিছানার দিকে তাকাই। আমি জানি, সে নেই। কিন্তু মন মানে না। তার ঘর, জামা-কাপড়, বই, সব যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে। আমি শুধু ওর গায়ের গন্ধ খুঁজে বেড়াই। যেন আবার এসে ডাক দেবে—‘মা, সকালে খাইনি এখনও।’ রিয়াদের বাবা আহম্মদ উল্লাহ বাদল আজ আর কিছু বলতে পারেন না। চোখের পানিই এখন তার ভাষা।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন