
জুলাই ছিল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে এক অমোঘ ডাক, জনতার এক জাগরণ। সেই আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল-ফ্যাসিবাদের বিলোপ করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা প্রশাসনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন নেই। মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি মন্ত্রণালয় প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী কর্মকর্তরা এখনো দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান সরকার গত দশ মাসে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। উল্টা দিকে প্রতিনিয়ত মাঠ প্রশাসনের জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক,এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ-বদলী এবং বিদেশী দুতাবাসে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ আমলারা। প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ কায়েমের সহযোগী ৪৪ জন আমলার অপসারণের দাবি জানিয়ে আবেদন নিয়েছে জুলাই মঞ্চ।এছাড়া ২৯তম বিসিএসের নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার ১৩ মাস পর এই ভুয়া ক্যাডারদের নিয়োগের সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা হয় গেজেট। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার সেই গেজেট প্রকাশ করেন।
এরই মধ্যে সেই ২১ জন কর্মকর্তাকে শনাক্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না ফ্যাসিস্ট আমলাদের নিয়োগ। অপর দিকে প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিবদের দ্রুত অপসারণসহ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে উপদেষ্টার চিঠি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। এ নিয়ে গত মে ২০ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাও বাস্তবায়ন নেই। এদিকে আজ বৃহস্পতিবার না হলে আগামী সপ্তাহে সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই প্রক্রিয়ায় আবারো ফ্যাসিবাদ হাসিনা সরকারের আমলাদের পদোন্নতির নামে তালিকায় রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচির উদ্ধোধন করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এক বছর আগে এ জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান রচনা করে আমাদের মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল। জুলাই ছিল দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে এক অমোঘ ডাক, জনতার এক জাগরণ। সেই আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল-‘ফ্যাসিবাদের বিলোপ করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ, রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, ২৪ এর জুলাই আমাদের ইতিহাসের অম্লাম এক স্মৃতি। একই সাথে বেদনা ও প্রতিজ্ঞার উপলক্ষ্য। স্বাধীন দেশে একটা নির্দিষ্ট সময়কালে এতগুলো মানুষ যাদের অধিকাংশই তরুণ মারা যাওয়া আমাদের জন্য বেদনা ও কষ্টের অনুভূতি তৈরি করে। এই কষ্ট ও বেদনার নীল আরো গাঢ় হয়ে আসে যখন তাদের আত্মহুতির এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন না করার বাস্তবতা সামনে আসে। এদিকে প্রশাসনে গণহত্যা ও ফ্যাসিবাদ আমলাদের চলতি জুলাই মাস থেকে অপসারণ করা হবে বলে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে সরকার এ সংক্রান্ত কমিটির মাধ্যমে সচিব পদায়নের জন্য একটি ফিটলিস্ট করেছেন। ফিটলিস্ট হতে সচিব পদায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বাস্তবায়েেনর জন্য আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপত্বি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার লালমনির হাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মিকে গতকাল বুধবার সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণপলয়ের সিনিয়র সচিব স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আসলে সব কিছু এবারে করা যায় না। সংস্কার কমিশনের সুপারিশের কাজ গুলো বাস্তবায়ন চলছে। তারপর প্রশাসনের কাজ প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে। শিগগিরই শূন্য থাকা সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে চারটি এসএসবির সভা হয়েছে আরো হবে। স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে কর্মকর্তা নির্বাচন করতে হয়েছে। অধিকাংশই বঞ্চিত ও যোগ্যরাই সচিব পদোন্নতি পাবেন। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিফলন বাস্তবায়ন করছি।
জানা গেছে,অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ৯ সচিব পদ শূণ্য রয়েছে। মাসের পর মাস এসব পদ শূন্য থাকলেও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সচিব পদে অতিরিক্ত সচিবকে কয়েক মাস থেকে রুটিন দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিচালনা করা হচ্ছে। দক্ষতার অভাবে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এজন্য বিভিন্নক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও ধীরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। দীর্ঘদিন শূণ্য থাকায় মেধাবী ও যোগ্যরা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। মন কষ্ট নিয়ে অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। গত বছর ৫ আগস্টে ক্ষমতাচ্যুৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। সচিব পদোন্নতি পাননি অনেক কর্মকর্তা। গত বছর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠনের পর তারা তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সচিব পদোন্নতি পাবেন এমনটি প্রত্যাশায় ছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে পদোন্নতি না পেয়ে তাদের কেউ কেউ অবসরে চলে গেছেন। তবে পদোন্নতি দেওয়ার লক্ষ্যে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় সচিবদের ফিটলিস্ট প্রস্তুত করা হয়। এক ডজন অতিরিক্ত সচিবের নাম রাখা হয়েছে। সেটির বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় শুণ্যসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
যে কারণে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিচালনায় সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তেমনি ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে খোদ সরকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিব পদ শূন্য থাকা অবস্থায় পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি না পেয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। এতে সরকারের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এপ্রেক্ষিতে শূণ্যসচিব পদে দ্রুত নিয়োগ দিতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সভাপতি, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ডিওতে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সরকার গত ৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটি গঠন করেছে। অন্যান্য কাজের সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে পদায়নের সুপারিশ করা এ কমিটির অন্যতম একটি কাজ। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ে সচিব পদায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে সরকার এ সংক্রান্ত কমিটির মাধ্যমে সচিব পদায়নের জন্য একটি ফিটলিস্ট প্রণয়ন করেছেন। উক্ত ফিটলিস্ট হতে সচিব পদায়নের সুপারিশ করা হবে। ফিটলিস্ট হতে আপনার মন্ত্রণালয়/বিভাগে সচিব পদায়নের বিষয়ে তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূণ্য থাকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীর গতিতে। শূণ্য পদে অতিরিক্ত সচিব রুটিন দায়িত্ব পালন করলেও তাদের নির্বাহি ক্ষমতা না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকছে। শূণ্য থাকা উল্লেখযোগ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হচ্ছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব), ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব), জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব), জাতীয় সংসদ সচিবালয়, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়, ডাক,তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যেকোনো সময় শূণ্য সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।