
খুলনার গডফাদার এরশাদ শিকদারের নৃশংসতার কাহিনী কী আজকের তরুণ প্রজন্ম জানে? শিল্পনগরী খুলনার একসময়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা খুনি এরশাদ শিকদারকে কেন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দলে ভিড়িয়েছিল? সেই রহস্য আজও অজানা।
খুনের বিচারে ফাঁসির মাধ্যমে এরশাদ শিকদার জমানার অবসান হলেও তার বাহিনীর নৃশংসতা আর ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে অনেকেই। এরশাদ শিকদারের গডফাদারদের কিছু কি হয়েছে কখনো?
পঞ্চাশের বেশি খুন হয়েছে এই এরশাদ শিকদারের হাতে। তার একসময়ের দেহরক্ষী নূর আলম একাই ছিল ২৩ খুনের সাক্ষী। টার্গেটকে হত্যা করে পেট কেটে ভেতরে পাথর ঢুকিয়ে সেলাই করে নদীতে ফেলে দেওয়া ছিল এরশাদ শিকদারের নৃশংসতার প্রিয় প্রক্রিয়া।
এরশাদ শিকদার। কুলি থেকে হয়েছে কোটিপতি। চুরি, গুম থেকে শুরু করে মানুষ খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত বাড়িয়েছে ক্ষমতার পরিধি আর প্রতিপত্তির বলয়। ঘাট ইজারাদার থেকে শুরু হয় তার পেশিশক্তির ব্যবহার। একসময় খুলনার কেন্দ্রীয় রাজনীতির সমীকরণে এরশাদ শিকদার হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এই এরশাদ শিকদার তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র নিজস্ব পেশিশক্তির মাধ্যমে নয়। এর পেছনে রয়েছে তার গডফাদার। গডফাদাররা নিজেদের প্রয়োজনেই তৈরি করেছে এরশাদ শিকদারকে।
জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ প্রত্যেকটি দলের শীর্ষ নেতারাই ব্যবহার করেছেন তাকে, তাদের নিজ স্বার্থে। বিনিময়ে এরশাদ শিকদার পেয়েছে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। প্রশাসন, পুলিশ সব জেনে-শুনে চুপ থেকেছে। কিন্তু গডফাদার যখন হয়ে ওঠে বিরাগ, তখন দেখা দেয় সমস্যা।
গ্রেপ্তার হয় এরশাদ শিকদার, প্রকাশিত হয় তার অপরাধ কর্মকাণ্ড। নেপথ্য কাহিনী হিসেবে প্রকাশিত হয় তার নারীঘটিত জীবন, হত্যা-কাহিনী আর সন্ত্রাসের ঘটনা। কিন্তু নেপথ্যে, অপ্রকাশিত থেকে যায় তার গডফাদার, ক্ষমতার উৎস।
গ্রেপ্তারের নেপথ্যে
এরশাদ শিকদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট। যদিও সে ধরা পড়েছে, না স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
গ্রেপ্তারের কিছুদিন আগেও সে ছিল আওয়ামী লীগ সদস্য। আওয়ামী লীগ নেতা চান মিয়ার স্ত্রী শোভাকে বিয়ে এবং যুবলীগ কর্মী খালিদকে হত্যার অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আগেও একাধিক খুনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল।
আওয়ামী লীগে সে যোগদান করেছিল '৯৭-এর শেষ দিকে। অথচ '৯৭-এর এপ্রিলে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষ এরশাদ শিকদারকে ২৩ মামলার পলাতক আসামি ও সন্ত্রাসী হিসেব চিহ্নিত করে তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। তারপরও প্রকাশ্যে খুলনা সার্কিট হাউজে পুলিশের উপস্থিতিতে '৯৭-এর ডিসেম্বরে সে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী তালুকদার আব্দুল খালেক, হুইপ এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মঞ্জুরুল ইমাম, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হারুন-অর-রশিদ, সাবেক মেয়র কাজী আমিন প্রমুখ। ক্ষমতার বলয়ে এরশাদ শিকদারের অবস্থান সব সময়ই সুসংহত। তাই পুলিশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল সে। কিন্তু এরশাদ শিকদারের সব হিসেব উল্টে দেয় খালিদ হত্যাকাণ্ড।
আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মনির, জেলা ছাত্রলীগ আহ্বায়ক অসিত বরণ বিশ্বাস, যুগ্ম আহ্বায়ক হানিফ, ছাত্রলীগ নেতা আকবর, যুবলীগ কর্মী খালিদ ও সৈয়দ মনিরের ভাই চয়ন ঘাট সংক্রান্ত ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে আলোচনার জন্য এরশাদ শিকদারের আমন্ত্রণে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাটে বরফকলে যান। সৈয়দ মুনির খুলনা জেলখানা ঘাট একাধিকবার ইজারা নিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল এরশাদ শিকদারের। এ জন্য সে সৈয়দ মুনিরের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
বরফকলে হাতের কাছে সৈয়দ মুনির ও সহযোগীদের পেয়ে এরশাদ শিকদার আক্রমণ করে তাদের। রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে সৈয়দ মুনিরকে। একপর্যায়ে তার দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেয় শরীর থেকে। হত্যা করে যুবলীগ কর্মী খলিলকে। অন্য ছাত্রলীগ নেতারা কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। খুলনার আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এসব নেতা তৎকালীন হুইপ মোস্তফা রশিদী সুজার অতি ঘনিষ্ঠজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খালিদ হত্যা ও নিজ অনুগামীদের ওপর হামলার কারণ জানতে চেয়ে সুজা ফোন করেন ঘনিষ্ঠ এরশাদ শিকদারকে। আলাপের একপর্যায়ে শুরু হয় তীব্র বাদানুবাদ।
একপর্যায়ে হুইপকেই হুমকি দেয় এরশাদ শিকদার। বলে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করলে হুইপ সুজার বাড়ির ইট খুলে নেয়া হবে। পাল্টা হুমকি দিয়ে সুজা বলেন, 'তোর সাম্রাজ্য না ভেঙে সুজা খুলনা শহরে ঢুকব না।’ এরপরের অংশ স্পষ্ট। যে এরশাদ শিকদারকে ধরতে পুলিশের বিন্দুমাত্র তৎপরতা ছিল না, তারা হঠাৎ অতি তৎপর হয়ে যায়। ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় চলতে থাকে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান। এরশাদ শিকদারের মাদক ব্যবসার আখড়া ঘাট এলাকাসংলগ্ন বস্তিতে লাগাতার অভিযান চালাতে থাকে পুলিশ।
বিপদে পড়ে এরশাদ শিকদার। সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালাতে থাকে সে। এই সময় ঢাকায় একাধিক উচ্চ মহলে যোগাযোগ করে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাকে পরামর্শ দেয়া হয় আগে ধরা দাও। তারপর বের করে আনা হবে। এই আশ্বাস পেয়ে ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট ধরা দেয় সে। এরপর বরফকল, ঘাট এলাকার সব স্থাপনা ভেঙে ফেলে প্রশাসন।
এরপর খুলনায় যান মোস্তফা রশিদী সুজা। এত কিছুর পরেও এরশাদ শিকদার হয়তো সহজেই ছাড়া পেয়ে যেত, যদি না তার দেহরক্ষী নূরে আলম ধরা পড় পড়ত। নূরে আলমের আদালতে দেয়া জবানবন্দির কারণেই ফেঁসে যায় এরশাদ শিকদার। নূরে আলমের ধরা পড়ার পেছনেও রয়েছে অন্য কাহিনী।
কারা এই গডফাদার? এরশাদ শিকদারের ক্ষমতার উৎস কী? অপরাধ জগতের গডফাদার হিসেবে এরশাদ শিকদারের মূল উত্থান জাতীয় পার্টির সরকারের সময়ে। ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট ইজারাদার কাশেম সর্দারকে হটিয়ে ঘাট দখল করে সে। বড় বাজারসহ পুরো এলাকায় একটা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
১৯৮৩ সালে বড় বাজার এলাকায় কমিশনার প্রার্থী হন জাপা নেতা কাজী আমিন। তার তীব্র বিরোধিতায় নামেন খুলনার তৎকালীন প্রভাবশালী জাপা নেতা শেখ আবুল কাশেম। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে এরশাদ ও তার বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হন কাজী আমিন। এরশাদ শিকদারের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কাজী আমিনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট, রেলওয়ে কলোনি ও মার্কেটের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে দাঁড়ায় এরশাদ শিকদার।
পাশাপাশি শুরু করে মদ, গাঁজা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা। সমগ্র খুলনায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। একপর্যায়ে কাজী আমিন মেয়র মনোনীত হন। তাতে এরশাদ শিকদারেরও প্রভাব বাড়ে। একই সময়ে কাজী আমিনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ আবুল কাশেমের সাথেও এরশাদ ভেতরে ভেতরে সম্পর্ক বজায় রাখে। নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ সরবরাহ করে দুজনকেই। কাজী আমিনের সাথে খুলনার দায়িত্বপ্রপ্ত মন্ত্রী কর্নেল (অব.) এইচ এম এ গাফফারের সুসম্পর্ক ছিল।
এভাবে কর্নেল (অব.) গাফফারেরও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসে এরশাদ শিকদার। এ পর্যায়ে তার পরিচিতি বাড়ে, সেই সাথে অর্থও। তবে পরবর্তীতে খুলনার বিএনপির মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমান আর আওয়ামী লীগের শেখ হেলালের সান্নিধ্যও পেয়েছেন গডফাদার এরশাদ শিকদার।
(ঢাকাটাইমস