Image description

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশসহ ৬টি দেশের অপরাধীরা জড়িত। এই চুরির জন্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এখন কানাডায় পালিয়ে আছেন।

সাইবার হ্যাকারদের মাধ্যমে এই রিজার্ভ চুরিতে সহযোগী হিসেবে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১ জনের একটি দুষ্টচক্র। এই চক্রের মূল হোতা পদচ্যুত ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক। ভারতীয় নাগরিক নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির দুই মাস্টারমাইন্ড।

নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির ঠিক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে চুরির দুয়ার খুলে দেন এবং রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির পর সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলেন। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান তার পছন্দের লোক হিসেবে এই দুজন ভারতীয় নাগরিককে নিয়োগ দিয়ে রিজার্ভ চুরির পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। চিহ্নিত অপরাধীর মধ্যে আরো ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা, আইটি বিভাগের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক দেব দুলাল রায় এবং বিএফআইইউয়ের সাবেক জিএম এবং উপদেষ্টা দেব প্রসাদ দেবনাথ।

এছাড়া সন্দেহভাজনের মধ্যে রয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি আনিস এ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর সাবেক প্রধান ও ডেপুটি গভর্নর কারাগারে আটক মাসুদ বিশ্বাস।

নিউ ইয়র্কে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরি করা হয়। রিজার্ভ চুরির এই ঘটনা দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ঘটনা সম্পর্কে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে ভয়াবহ তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। অনুসন্ধানকালে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহে খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং সিআইডির তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে যেসব হ্যাকার সরাসরি জড়িত ছিলেন, তারা মূলত ফিলিপাইন, চীন, শ্রীলঙ্কা ও জাপানের নাগরিক। যাদের সহযোগিতায় রিজার্ভ চুরি হয়েছে, তারা বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক।

রিজার্ভ চুরির ঘটনা ২৯ দিন লুকিয়ে রাখেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও ঘটনাটি জানাননি। তিনি ২২ দিন পর ঘটনাটি জেনে ড. আতিউরের ওপর ক্ষুব্ধ হন। মামলা হওয়ার পর সিআইডির ওপর রিজার্ভ চুরির তদন্তভার দেওয়া হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান চাপ সৃষ্টি করে তদন্ত থামিয়ে দেন। সে সময় সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয় পাঁচবার। সাবেক গভর্নর এবং সরকারের এই প্রভাবশালীরা ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অব্যাহত চেষ্টা চালান। এই ধামাচাপা দেওয়ার সঙ্গে আইনজীবী আজমালুল হক কিউসিও জড়িত ছিলেন। একজন কট্টর আওয়ামীপন্থি আইনজীবী হিসেবে সরকার তাকে নিয়োগ দেয়।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পদচ্যুত ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান রিজার্ভ চুরির আগে কয়েকবার আমেরিকা যান। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ছাইদুর রহমানের আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়। সন্দেহ করা হচ্ছে, হ্যাকারদের মাধ্যমে রিজার্ভ চুরির পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে জয়ও একজন হতে পারেন। বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করছে।

রিজার্ভ চুরি নিয়ে কথা বলার জন্য তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ড. ফরাসউদ্দিনকে ফোন করলে তিনি বলেন, সরকারের কাছে তার প্রতিবেদন জমা আছে। এ বিষয়ে কিছু বলা সমীচীন হবে না। ড. আতিউর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও উত্তর দেননি। কাজী ছাইদুর রহমানও ফোন ধরেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসের ইডি মেজবাউল হক বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না। এ দুজনেরই বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা এখন বাংলাদেশে নেই।

রিজার্ভ চুরির ঘটনা পর্যালোচনা করে সরকারকে তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ দেওয়ার জন্য আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ে একটি কমিটি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও এই কমিটির সদস্য। কমিটি এখন পর্যন্ত তিনটি বৈঠক করেছে। এদিকে আগামীকাল বুধবার আদালতে সিআইডির প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। সিআইডি এই প্রতিবেদন দিতে এ পর্যন্ত ৮৫ বার সময় নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, তদন্তে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, কাউকে ছাড়া হবে না।

নিউ ইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের একটি আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির টাকা উদ্ধার ও ক্ষতিপূরণের মামলা করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ৩৫টি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভের নিউ ইয়র্ক শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালায় হ্যাকাররা। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার তারা লোপাট করতে সক্ষম হয়।

এই অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যায় ২ কোটি ডলার, বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আরসিবিসি ব্যাংক হয়ে ফিলিপাইনের বিভিন্ন কেসিনোতে ঢুকে যায়। চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে; বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ চুরি হওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে মামলা করেছে।

রিজার্ভ চুরির সেই কলঙ্কিত মুহূর্তগুলো

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিট। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৯তলা ভবনের নবম তলায় অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ। সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজউদ্দিন তার কম্পিউটার লগ আউট করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সুইফট বার্তার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ৮ কর্মকর্তার মধ্যে তিনি একজন। লগ আউটের আগে ১৮টি সুইফট বার্তার মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ অব নিউ ইয়র্কে রাখা রিজার্ভ থেকে ৩১ কোটি ৯৭ লাখ এক হাজার ২০১ মার্কিন ডলার পেমেন্ট ট্রান্সফারের নির্দেশনা দিয়ে তিনি অফিস ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে রিয়াজউদ্দিন একবারের জন্যও ভাবতে পারেননি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত একটি রাত পার করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন সবচেয়ে বড় রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এই রাতে।

রিয়াজউদ্দিন তার কম্পিউটার লগ আউট করে চলে যাওয়ার পরপরই রাত ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত মোট ৩৫টি প্রতারণামূলক সুইফট বার্তার মাধ্যমে হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ অব নিউ ইয়র্ককে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার ৮৮৬ মার্কিন ডলার বিদেশি ব্যাংকে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। এর মধ্যে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক ম্যানিলায় ৪টি সুইফট বার্তা ও শ্রীলঙ্কায় একটি সুইফট বার্তার মাধ্যমে ওই অর্থ স্থানান্তর হয়ে যায়। তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা তা জানেন না!

পরদিন শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। বাংলাদেশে চলছে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হওয়ার কারণে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্ট খোলা থাকে ছুটির দিনেও। এদিন যথারীতি অফিসে আসেন বিভাগের কর্মকর্তা জুবায়ের বিন হুদা। তিনি দেখতে পান সুইফট বার্তা আদান-প্রদানের প্রিন্টার মেশিনটি কাজ করছে না। কারিগরি ত্রুটি মনে করে জুমার নামাজের কথা বলে তিনি অফিস ত্যাগ করেন।

পরদিন শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। যথারীতি ওইদিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অফিসে আসেন। প্রিন্টারটি ঠিক করা হলো। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রিন্টার থেকে পাওয়া গেল ফেডারেল রিজার্ভ অব নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ট্রান্সফারের ৩৫টি প্রতারণামূলক সুইফট বার্তা। উপস্থিত কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেল না। এ বিভাগের কর্মকর্তা বদরুল হক বিষয়টি নিয়ে ডেপুটি গভর্নর এবং গভর্নরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল না। উপস্থিত কর্মকর্তাদের পরামর্শক্রমে বদরুল হক যোগাযোগ করলেন রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের (FRTMD) তৎকালীন জিএম কাজী ছাইদুর রহমানের সঙ্গে। তিনিও বিষয়টি তার এখতিয়ারে নয় বলে এড়িয়ে গেলেন। অথচ রিজার্ভ থেকে ফান্ড ট্রান্সফারের অরিজেনিটিং সেকশন ‘ফ্রন্ট অফিস’ এবং ফান্ড ট্রান্সফারের যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করার সেকশন ‘মিডল অফিস’ ছাইদুর রহমানে দায়িত্বে থাকা ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আওতাধীন। সবচেয়ে বেশি দায়দায়িত্ব তার ওপর বর্তালেও তিনি সেদিন অফিসে এসে বিষয়টি সরেজমিনে দেখে ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অথচ রিজার্ভ চুরির ঘটনার কিছুদিন আগেই তিনি ফেডারেল রিজার্ভ অব নিউ ইয়র্কে রিজার্ভ সংক্রান্ত একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন। রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টের ওপর ট্রেনিং সেমিনার ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের জন্য এই কর্মকর্তা অনেকবার আমেরিকায় যান। এটা ব্যাংকে বিরল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর থেকে ডেপুটি গভর্নর হওয়া পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ৩৫ বছরের অধিককাল তিনি (FRTMD)-এর দায়িত্বে ছিলেন। যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে অত্যন্ত খারাপ নজির হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।

ছাইদুর রহমানকে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম কুশীলব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তদন্ত রিপোর্টে। এই ছাইদুর রহমান এমন একজন কর্মকর্তা যার একান্ত অনুগত ও অনুসারী ছাড়া (FRTMD) বিভাগের অন্য কোনো কর্মকর্তার পদায়ন হওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তার সঙ্গে আপসরফা ছাড়া ব্যাংকের প্রয়োজনের সময় বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করাও ছিল অসম্ভব ব্যাপার। এটি ব্যাংকিং সেক্টরে সর্বজনবিদিত। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অত্যন্ত অপদস্থ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়ে এ কর্মকর্তা যখন পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বর ত্যাগ করেন, তখন শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে ঘিরে ‘রিজার্ভ চোর... রিজার্ভ চোর’ বলে স্লোগান দেন।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে তৎক্ষণাৎ যা হয়

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত হ্যাকাররা নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব থেকে ৩৫টি প্রতারণামূলক সুইফট বার্তার মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার স্থানান্তরের বার্তা পাঠায়। আগেই উল্লেখ করেছি, ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি রোববার নিউ ইয়র্কে ছুটির দিন। তারপর দিন ৮ ফেব্রুয়ারি চায়না হলিডের কারণে ফিলিপাইনে বর্ধিত ছুটির দিন। হ্যাকাররা আগে থেকেই টানা ছুটির এ চার দিনের অপেক্ষায় ছিল। পরিকল্পনামাফিক এ ছুটির দিনে প্রতারণামূলক অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে নিজেদের হিসাবে অর্থ বুঝে নিয়ে সটকে পরাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।

চুরির ঘটনাটি ঘটে ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সুইফট বার্তা আদান প্রদানের প্রিন্টার মেশিনটি নষ্টের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জুবায়ের বিন হুদা এটিকে যান্ত্রিক ত্রুটি মনে করে জুমার নামাজের কথা বলে অফিস ত্যাগ করেন। পরদিন শনিবার প্রিন্টার ঠিক করা হলে অনেকগুলো প্রতারণামূলক সুইফট বার্তার কপি দেখতে পেয়ে উপস্থিত কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে আনলেও যথাসময়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা থানায় জিডি করতে চাইলেও তা করতে দেওয়া হয়নি। ১ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত এ বিষয়ে কাউকে কোনো কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

দুই ভারতীয় নাগরিকের মাধ্যমে যেভাবে রিজার্ভ চুরি হয়

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমানই রিজার্ভ চুরির পথ করে দেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইটি বিশেষজ্ঞ নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা নামে দুজন ভারতীয় নাগরিককে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে এ পথ সৃষ্টি হয়। এ দুজন ভারতীয় নাগরিক ড. আতিউরের খুব পছন্দের ছিল। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তা নষ্ট করে দিয়ে চুরির দুয়ার খুলে দেন এবং রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির পর সিস্টেম থেকে চুরির সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলেন।

রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল দেশের অভ্যন্তরে স্থানীয়ভাবে লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত ‘RTGS'-এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ব্যবহৃত ‘SWIFT SYSTEM'-এর সংযোগ স্থাপন। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এর ফলে একসঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কম্পিউটার এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটিএন-এর কয়েক হাজার কম্পিউটারের লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক। সংযোগ স্থাপনের এ কাজটিই করেন ভারতীয় নাগরিক নীলা ভান্নান। গভর্নরের নির্দেশে তাকে এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তৎকালীন ইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা, আইটি বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা ও বর্তমান ওই বিভাগের ইডি দেব দুলাল রায়। নীলা ভান্নান তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কর্মকর্তা রিয়াজ, সালেহীন ও জোবায়ের বিন হুদার ইউজার আইডি এবং ফিঙ্গার স্ট্রোক, পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অতি সন্তর্পণে জেনে নিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। রিজার্ভ চুরির পেছনে তাই অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত নীলা ভান্নান।

পরিকল্পনা অনুযায়ী হ্যাকাররা ২০১৫ সালের প্রারম্ভেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমে একটি Malware Virus প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়, যার সুবাদে রিজার্ভ থেকে অর্থ স্থানান্তরের জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটারের আইডি ও পাসওয়ার্ড তারা জেনে যায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩৬ জন কর্মকর্তার কাছে ম্যালওয়ারযুক্ত ইমেইল পাঠানো হয়। অন্তত ৩ জন কর্মকর্তা তাতে সাড়া দেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের প্রটোকল অফিসার আসাদুজ্জামান। এ তিনজন ম্যালওয়ারযুক্ত অ্যাটাচমেন্ট ফাইল ওপেন করেন। আর এতে খুব সহজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ঢুকে পড়ে হ্যাকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যায়। তারা অনায়াসেই সাইবার সিকিউরিটির প্রাচীর ভাঙতে সমর্থ হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কম্পিউটার পরস্পরের সঙ্গে ইন্টার কানেকটেড থাকায় হ্যাকাররা একটার পর একটা কম্পিউটার ঘুরে শেষ পর্যন্ত সুইফট-এর সঙ্গে সংযুক্ত কম্পিউটারের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

রিজার্ভ চুরির পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার থেকে রিজার্ভ চুরির সব তথ্য, ডকুমেন্ট মুছে ফেলা হয়। দীর্ঘ দেড় মাস ধরে এ কাজটি করেন ড. আতিউরের নিয়োগ দেওয়া অপর ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় আইডি বিশেষজ্ঞ কাউকে না জানিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে গভর্নর আতিউর এ কাজে নিয়োগ দেন রাকেশ আস্তানাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডিজিএম মেজবাউল হকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নেপথ্যে থেকে রাকেশ আস্তানা কাজ করে যান। রাকেশ আস্তানাকে সব সহযোগিতা করার জন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন তৎকলীন জিএম কাজী ছাইদুর রহমান। তাদের আনুকূল্যের সুবাদে রাকেশ আস্তানা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার কক্ষে ঢুকে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার থেকে রিজার্ভ চুরির সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলতে সক্ষম হন। সিআইডির ফরেনসিক তদন্তেও রাকেশ আস্তানার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে।

গভর্নর তার দুষ্টচক্রের কাছে এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে, তিনি তাদের পরামর্শে স্থানীয় আইটি বিশেষজ্ঞ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দারস্থ না হয়ে তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তার পূর্বপরিচিত ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানাকে চুরির অর্থ খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেন। ভারতীয় এই ব্যক্তি ছিলেন ‘ওয়ার্ল্ড ইনফোম্যাট্রিক্স সাইবার সিকিউরিটি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। অত্যন্ত রহস্যজনক বিষয় হলো এই যে, কোনো ধরনের লিখিত অনুমতি বা ইনডেন্ট ছাড়াই রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩১টি কম্পিউটার রাকেশ আস্তানার কাছে হস্তান্তর করা হয়। গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে এ কাজটি করা হয়। সুইফট সংক্রান্ত কম্পিউটারের ওপর ফরেনসিক নিরীক্ষা এবং কাজ শেষে কোনো ধরনের লিখিত নোট কিংবা অফিস আদেশ ছাড়াই এ কম্পিউটারগুলো পুনরায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। যদিও লিখিত অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য। রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ১৫ মার্চ ২০১৬ মামলা হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা এসব কম্পিউটারে রিজার্ভ চুরির সব তথ্য-উপাত্ত ও ডকুমেন্টস বিনষ্ট করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হন। তৎকালীন সিআইডি মূখপাত্র Organised Crime Special Superintendent মোল্লাহ নজরুল জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশকিছু কর্মকর্তাসহ রাকেশ আস্তানা এই সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। প্রকৃত অর্থে রাকেশ আস্তানার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক। তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষিত আইটি রুমে প্রবেশ করানো এবং সব আলামত নষ্ট করার সুযোগ করে দেন রিজার্ভ চুরির অন্যতম অভিযুক্ত ও সিআইডির তদন্তে দোষী বলে চিহ্নিত কর্মকর্তা কাজী ছাইদুর রহমান ও ইডি মেজবাউল হক। রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড খ্যাত কাজী ছাইদুর রহমানের (৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পদচ্যুত ডেপুটি গভর্নর) একান্ত অনুসারী ও অনুগত এই কর্মকর্তা মেজবাউল হক এখনো কাজী ছাইদুর রহমানের নির্দেশমতো দেশ ও আর্থিক খাত ধ্বংসকারী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসর ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ এই মেজবাউল হক পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক পদে দায়িত্বে থাকাকালে কোটি কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটর ‘নগদ’-কে নিয়মবহির্ভূতভাবে লাইসেন্স প্রদান করেন, যা আর্থিক খাতে সর্বজনবিদিত।

ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় যেভাবে টাকা স্থানান্তর হয়

অবৈধ অর্থ লেনদেনের জন্য ফিলিপাইনের ক্যাসিনো সাম্রাজ্য ও অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেছে নেওয়া হয়। তাই রিজার্ভ চুরির অর্থ স্থানান্তরের জন্য হ্যাকারদের পছন্দের শীর্ষে ছিল ফিলিপাইন। এই লক্ষ্যে তারা ম্যানিলায় আরসিবিসি মাকাতি শাখায় ২০১৫ সালের মে মাসে একজন চীনা নাগরিকের মাধ্যমে ৫০০ ডলার জমা দিয়ে ৪টি হিসাব খোলে। হিসাব খোলার পর ফেব্রুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ৯ মাস তারা একেবারেই চুপচাপ ছিল, যাতে কোনো সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। ৩৫টি পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন পাওয়ার পর ফেডারেল রিজার্ভ অব নিউইয়র্ক দেখতে পায় যে, প্রতিটি পেমেন্টের বেনিফিশিয়ারি ব্যক্তিবিশেষ, কোনো কোম্পানি বা করপোরেশন নয়। তাছাড়া প্রতিটি পেমেন্টের পরিমাণ ছিল গড়ে সাড়ে নয় মিলিয়ন ডলার। এতে করে তাদের সন্দেহ হয় এবং তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেনিফিশিয়ারির বিষয়ে অধিকতর ব্যাখ্যা চায়। এর ফলে ৩৫টি বার্তার মধ্যে ৩০টি বার্তার পেমেন্ট বন্ধ করা সম্ভব হলেও ৫টি বার্তার বিপরীতে ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার স্থানান্তরিত হয়ে যায়। যার মধ্যে ১টি বার্তার বিপরীতে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার শ্রীলঙ্কায় এবং ৪টি বার্তার বিপরীতে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের ৪টি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয় যা একক ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত।

শ্রীলঙ্কায় প্রেরিত মার্কিন ডলার ২০ মিলিয়নের বেনিফিশিয়ারি ছিল Shalika Foundation নামীয় একটি অলাভজনক এনজিও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু হ্যাকাররা Foundation শব্দটিকে ভুল করে Fandation উল্লেখ করায় সন্দেহের উদ্রেক হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে এ পেমেন্টটিকে আটকে দেওয়া সম্ভব হয়। পরবর্তীকালে অনুসন্ধানে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার নিবন্ধন তালিকায় Shalika Foundation নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। প্রতারণামূলক নির্দেশের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় প্রেরিত ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পুরোটাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আর ফিলিপাইনে স্থানান্তরিত ৮১ মিলিয়ন থেকে মাত্র ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

সাবেক গভর্নর ড. আতিউরের ভূমিকা

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের ভূমিকা শুরু থেকেই ছিল রহস্যজনক। তিনি ঘটনাটি ১ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে মামলা করতেও কর্মকর্তাদের নিষেধ করেন। ঘটনার কয়েকদিন পর তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে শুধু জানান। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ড. আতিউর রহমান তাদেরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি তার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে, এ ঘটনা আপাতত প্রকাশ করা যাবে না। মিডিয়ায় রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশিত হলে নাকি সরকারের দুর্নাম হবে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি ড. আতিউর রহমান রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিতকেও জানাননি। তিনি সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অর্থমন্ত্রীকে আমলে নিতেন না।

কর্মকর্তারা অর্থমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দিলে আতিউর বলেছিলেন, ‘ওই ব্যাটা বেশি কথা কয়। প্রেসকে বলে দেবে।’ অর্থমন্ত্রী মুহিত কিছুদিন পর রিজার্ভ চুরির ঘটনা শুনে ড. আতিউরের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে চুপ করিয়ে দেন। যদিও এ ঘটনা ম্যানিলার একটি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের পর জানাজানি হয়ে যায়। ড. আতিউর ও তার অনুগত চক্র রিজার্ভ চুরির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ম্যানিলার ‘দ্য ইনকোয়ারার’ পত্রিকায় ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। এর ফলে পৃথিবীর সব মানুষ তা জানতে পারে। বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের আর্থিক খাতে ঘটনাটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক নিরাপত্তা ও লেনদেন ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং কীভাবে ‘সাইবার হ্যাকিং’ থেকে আর্থিক খাতকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে তৎপরতা শুরু করে।

বাংলাদেশেও এর তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েন গভর্নর আতিউর রহমান। ফলে ১৫ মার্চ ২০১৬ তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এ পদত্যাগ নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তার পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার কথা অর্থমন্ত্রীর দফতরে। একই কারণে তৎকালীন দুজন ডেপুটি গভর্নরও পদত্যাগ করেন। তারা হলেন ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানা।

ড. আতিউর ছিলেন অযোগ্য ও তোষামোদকারী

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ড. আতিউর রহমান ছিলেন খুবই অযোগ্য একজন মানুষ। তার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তিনি অদূরদর্শী, ভাবাবেগতাড়িত তোষামোদকারী। তার চারপাশে অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। তিনি স্তুতিপ্রিয়। নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসতেন। তাই অসাধু কর্মকর্তারা তাকে তেলবাজি করে স্বার্থ হাসিল করত।

আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ ও সর্বশেষ অগ্রগতি

রিজার্ভ চুরির ২৪ দিন পর ১৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে সাবেক গভর্নর মো. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ছিলেন- বুয়েটের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোকুল চাঁদ দাস। কমিটি তদন্ত শেষে ৩০ মে ২০১৬ তারিখে ৬১ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেন। উল্লেখ্য, ১৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও একটি মামলা দায়ের করা হয়। অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের উপ-পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় এই মামলাটি করেন। সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী না করে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে এই মামলাটি করা হয়। এই মামলার তদন্তভার সিআইডির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বাইরে ইউএসএ’র এফবিআই কর্তৃক পৃথক একটি তদন্ত পরিচালনা করা হয় এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে ২০১৮ সালে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।

রিজার্ভ চুরির কারণ, নেপথ্যে জড়িত ব্যক্তিরা

রিজার্ভ চুরির মূল কারণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরিটি সিস্টেমের দুর্বলতা, দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের অসতর্কতা, অসাবধানতা ও অবহেলা। অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কিছু কর্মকর্তার ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি ব্যবহার করে হ্যাকাররা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। উক্ত বিভাগের কর্মকর্তা শেখ রিয়াজউদ্দিন, সালেহীন, জোবায়ের বিন হুদার নাম প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এমনকি ফরাসউদ্দিনের রিপোর্টের বরাত দিয়েও তাদেরকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ হলো এফআরটিএমডি। এ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা, ভারতীয় দুজন নাগরিকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ ও রহস্যজনক। রিজার্ভের অর্থ সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও পরিচালনার মূল দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের Forex Reserver And Treasury Management (FRTMD) বিভাগের। রিজার্ভের অর্থ লেনদেন, স্থানান্তর ও বিনিয়োগসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় FRTMD-এর ফ্রন্ট অফিস ও মিডল অফিসের মাধ্যমে। লেনদেন স্থানান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হয় অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিসের মাধ্যমে। তাই রিজার্ভ চুরিতে FRTMD বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। রিজার্ভ চুরির সময় FRTMD-এর মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন কাজী ছাইদুর রহমান। জানা যায়, রিজার্ভ চুরির অল্প কয়েকদিন আগে তিনি নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। তার কাছে ফেডারেল রিজার্ভ নিউ ইয়র্কের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার ই-মেইল, পার্সোনাল ও অফিসিয়াল মোবাইল নম্বর সংরক্ষিত ছিল। তিনি এত বেশিবার ফেডারেল রিজার্ভ নিউ ইয়র্কে ট্রেনিং ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন যে, তার সঙ্গে ফেডারেল রিজার্ভ নিউ ইয়র্কের অনেক কর্মকর্তার সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাই রিজার্ভ চুরির দিন অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে তাকে এ বিষয়টি জানানো হলে তিনি ছিলেন নির্বিকার ও নিষ্ক্রিয়। তার এ ভূমিকা আজও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অত্যন্ত ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করেন।

ছাইদুর ও মেজবাউলকে ঘিরে অপরাধী চক্র

কাজী ছাইদুর রহমান ও মেজবাউল হক বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা অপকর্মের নায়ক। তাদের নেতৃত্বে ব্যাংকে একটি অপরাধী চক্র গড়ে ওঠে। এ চক্রের সঙ্গে আরো ছিলেন তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা, বর্তমান নির্বাহী পরিচালক দেব দুলাল ও দেব প্রসাদ দেবনাথ প্রমুখ। এরা রিজার্ভ চুরির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যেমন ছিলেন তেমনি ব্যাংকের নানা অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত। অভাবনীয় কায়দায় নিজেরা একের পর এক পদোন্নতি নিয়েছেন। রিজার্ভের স্থিতি বাড়িয়ে দেখানো, কৃত্রিমভাবে ডলারের সঙ্গে টাকার মান বাড়িয়ে দেখানো, ডলার বাজার অস্থিতিশীল করা, বিদেশে ডলার পাচার ও ঘুস-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

রিজার্ভ চুরি নিয়ে হলিউডে সিনেমা

হলিউডের ইউনিভার্সেল স্টুডিও থেকে ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে সিনেমা হয়েছে। একদল হ্যাকার কীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে সক্ষম হয় এবং হ্যাকারদের সামান্য ভুল টাইপের কারণে আরো বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রক্ষা পায়Ñসেই অবিশ্বাস্য কাহিনিই উঠে এসেছে সিনেমায়।