বাকস্বাধীনতা কিংবা ভোটাধিকারের মতো মৌলিক অধিকারকগুলোও যখন ছিল অধরা, ঠিক সেই সময় শ্যামল বাংলার বুকে নেমে আসে-জুলাই বিপ্লব। কোনো রাজনৈতিক ব্যানার কিংবা পরিচিত নেতার মুখ নয়, একদল শিক্ষার্থী রাজপথে নামেন সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে।
২০১৮ সালে সরকারে জারি করা সার্কুলারকে ২৪ সালের ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। এরপরই ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিলের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ২৪ দিনের বিরতির পর ১ জুলাই কোটা বাতিলের নির্বাহী আদেশের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ৫ জুলাই থেকে কর্মসূচি আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে।
বলা চলে অহিংস একটি আন্দোলনকে বিক্ষুব্ধ করেন শেখ হাসিনার নিজেই। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?
এ কথা শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। গতি বাড়ে আন্দোলনে। জুলাইয়ের একেকটি দিন ছিল রাতেরও চেয়ে অন্ধকার। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চরিত্র পায় গোটা আন্দোলন। আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় সব শ্রেণিপেশার মানুষ। বুলেট উপেক্ষা করে ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তিমুখীন জনতা নেমে আসেন রাজপথে। ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে দেড় হাজারের বেশি মানুষের আত্মত্যাগে স্বৈরাচার মুক্ত হয় বাংলাদেশ। শুরু হয় নতুন ইতিহাস।
৩ আগস্ট শহীদ মিনারে এক দফার ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম। ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হোন শেখ হাসিনা। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হান্নান মাসুদ বলছেন, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শেখ হাসিনার পতন।
মাসুদ বলেন,
আমাদের কাছে সব সময় স্বপ্ন ছিল যে কোনো একটা সুযোগ আসলে শেখ হাসিনার পতনের দিকে আগাবো। ১৬ জুলাই রাতে যখন ছাত্রলীগকে বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, তখনই শেখ হাসিনার পতনের প্রথম ধাপ শুরু হয়ে যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম মনে করেন, দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো সাধারণ মানুষের।
সারজিস আলম বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে দেয়ালে মানুষের পিঠ ঠেকে যায়। মানুষ তাদের সন্তানদের জীবন দিতে দেখলো, তখন তাদের ভয়টা কেটে গেল। তাই তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের ডাকে রাজপথে নেমে আসেন। দিনশেষে এটা অভ্যুত্থানের দিকে যায়।’
গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান মুখ নাহিদ ইসলাম উত্তাল সেই সময়ের স্মৃতিচারণায় বলছেন, জুলাইয়ের অংশীজনদের অনৈক্যের কারণে বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি এখনও। তবে হাল ছাড়তে রাজি নন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন,
আশা করেছিলাম রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকবে। সবাই একসঙ্গে কাজটা এগিয়ে নেবে। কিন্তু এজেন্ডাগুলো ভাগ হয়ে গিয়ে অনৈক্য তৈরি হয়েছে। ফলে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই যে আমরা বলছি, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বা একটা হতাশা আছে সবার মাঝে-- এটাই প্রমাণ করে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাটা অনেক বড় ছিল।
অন্যায় আর অবিচারকে বাংলার মানুষ যে অন্ততকাল ধরে মেনে নেয় না তারই জ্বলজ্বলে উদাহরণ ২০২৪- এর জুলাই। যে জুলাইয়ের ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক পাটাতনকে নতুন করে নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় নতুন বন্দোবস্তের পথে কতটুকু হাঁটতে পারে বাংলাদেশ।