Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাতিসংঘ, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগিতার বিষয়ে মতবিনিময় করছেন।

জানা গেছে, আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করতে যাচ্ছে ইইউ। আগামী মাসেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল ঢাকায় পৌঁছতে পারে বলে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র আমার দেশকে নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক জানিয়েছেন, প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধান টিম পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইইউকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ইইউর পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছিল তা অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। এই প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দলের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ইইউ সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করবে কি না।

বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিঠি পাওয়ার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠিটি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গত ২৫ জুন নির্বাচন কমিশন ইইউর আবেদনে অনুমোদন দেয়। ২৬ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্রাসেলসে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে ইইউ সদর দপ্তরকে বাংলাদেশ সরকারের এই ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ কূটনীতিক আমার দেশকে জানিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন তাদের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর ব্যাপারে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী মাসেই হয়তো তাদের টিম ঢাকায় এসে পৌঁছবে।

আগামী সাধারণ নির্বাচনের বাকি প্রায় আট মাস। এত আগে কেন ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে—এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকাস্থ ইইউ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম অত্যন্ত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। নির্বাচনের কমপক্ষে ছয় মাস আগে থেকেই কার্যক্রম শুরু করতে হয়। বিশেষ করে প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দলের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দলের রিপোর্টের ওপর সিদ্ধান্ত হবে মূল পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হবে কি না।

ইইউ দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধান দলের কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন তারা। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস, কর্মকৌশল, মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটসহ সার্বিক বিষয়ে প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল তাদের সুপারিশ তুলে ধরে ইইউ সদর দপ্তরে রিপোর্ট পেশ করবে। এই রিপোর্ট তৈরির জন্য প্রাক-অনুসন্ধানী দল সরকার, নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফরের মাধ্যমে প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল সরেজমিনে সার্বিক পরিস্থিতি যাচাই করবে।

বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে উল্লেখ করে ইইউ দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়া মূল্যায়নের জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক মোতায়েন করা হয়। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

এর আগে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হবে কি নাÑতা যাচাইয়ের জন্য ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রিকার্ডো রেলেরির নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল বাংলাদেশে পাঠায়। ওই দলটি বাংলাদেশে এক মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে দেড় শতাধিক বৈঠক করে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে তখন ইইউ সদর দপ্তর ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউ ছাড়া আর কোনো দেশ বা সংস্থা এখন পর্যন্ত কোনো অনুরোধ জানায়নি। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে এলে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওয়াইসি, সার্ক, আসিয়ানসহ বিভিন্ন আর্ন্তাজিত সংস্থার পাশাপাশি অনেক দেশের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দল আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, সাধারণভাবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি এখনো সুস্পষ্ট নয়। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই), ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) মতো সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। এসব সংস্থাকে ইউএসএআইডির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএআইডির কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কীভাবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘেরও রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। ঢাকায় সংস্থাটির আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস জানিয়েছেন, আমরা আগামী দিনে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে চাই। এই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয কারিগরি সহায়তা দেবে বলেও জানান তিনি।