Image description
 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন দেশটিতে কর্মরত কয়েকশ প্রবাসী বাংলাদেশি। পরে তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথম পর্যায়ে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশিদের মুক্তি দেওয়া হলেও নতুন করে গ্রেপ্তার হচ্ছেন বাকিরা। কিন্তু এসব গ্রেপ্তার ব্যক্তির মুক্তিতে কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। এ নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে গ্রেপ্তার ব্যক্তির স্বজন ও সহকর্মীদের মাঝে। ভুক্তভোগী প্রবাসীর স্বজনদের একাধিকবার আন্দোলনের মুখে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও বন্দিদের মুক্তিতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এজন্য সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছে ভুক্তভোগী পরিবার।

 

এদিকে বিদেশে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের কতজন জেলে বন্দি আছেন, তা নিয়ে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয়ের তথ্যেও অসামঞ্জস্য লক্ষ করা গেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, সর্বশেষ ২৭ জনের তালিকা আছে তাদের কাছে। তবে ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, তাদের কাছে ২০ জনের তালিকা আছে। তবে তাদের মুক্তিতে আলাদা করে কিছু করার নেই বলে জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সে দেশের আইন অনুযায়ীই মুক্তি হবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়।

 

এদিকে, ‘জুলাই আন্দোলনে জেলবন্দি রেমিট্যান্স যোদ্ধা পরিবার’ নামে একটি সংগঠন বলছে, আবুধাবির আল সদর জেলেই বন্দি আছেন ২৫ জন বিক্ষোভকারী বাংলাদেশি। অন্যান্য জেল ও দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বন্দি আছেন আরো অনেকে। তবে সে সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দায়সারা কাজ করছে বলে অভিযোগ সংগঠনটির।

 

সংগঠনটির দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ফোনে যদি ১৮৯ জন জেলবন্দির সাজা মওকুফ হয়ে দেশে আসতে পারে, তাহলে বাকিদের ক্ষেত্রে বৈষম্য কেন? তারা তো একই ঘটনার জন্য অভিযুক্ত।

এদিকে আটক ও জেলবন্দি প্রবাসীদের মুক্তির দাবিতে একাধিকবার আন্দোলন করার পর আশাহত হয়ে গত ২২ জুন রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগী জেলফেরত প্রবাসী ও বন্দিদের স্বজনরা। আন্দোলন করার অপরাধে আবুধাবির আলসদর কারাগারে আটক ২৫ জনসহ আমিরাতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে আটক প্রবাসীদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করাসহ সরকারকে চার দফা দাবি জানান তারা।

 

গত বছরের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে মিছিল করেন কয়েকশ প্রবাসী। ওই ঘটনার পর তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় পুলিশ। সে দেশের আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাউকে ১০ বছরের জেল এবং কাউকে যাবজ্জীবন সাজা দেয় সেখানকার আদালত। পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ফোনে তাদের সাজা মাফ করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের ব্যাপারে উদাসীন মনোভাব সরকারের।

 

তথ্যমতে, গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাজাপ্রাপ্তদের পরিবার মুক্তির জন্য উপদেষ্টাদের কাছে আবেদন জানায়। এরপর ১২ আগস্ট তাদের মুক্তির জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেয় দূতাবাস। ২৮ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান অভিনন্দন জানাতে প্রধান উপদেষ্টাকে টেলিফোন করলে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশিদের মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ জনসহ আটক মোট ১১৪ জন বাংলাদেশির শাস্তি মওকুফ করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আমিরাত সরকার। তবে এই কর্মীদের আরব আমিরাতে প্রবেশে ‘নো-এন্ট্রি’ দেওয়ায় তারা আমিরাতসহ উপসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত তথা গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) ছয়টি দেশে আপাতত প্রবেশ করতে পারবেন না। তা ছাড়া শাস্তি মওকুফের পর গত ৭ সেপ্টেম্বর দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জনের মধ্যে প্রথম ধাপে ১৪ জন দেশে ফেরত আসেন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে গত ২৯ নভেম্বর আরো ৭৫ বাংলাদেশিকে ক্ষমা করে আরব আমিরাত।

 

সূত্র জানায়, বর্তমানে যারা বন্দি আছেন তাদের বেশিরভাগকেই দেশে আসার সময় বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করে তাদের ডাটা আমিরাতের ইমিগ্রেশনে দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এতে যারাই দেশে আসার জন্য বিমানবন্দরে আসবেন, সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশনে তাদের আটক করা হবে।

ভুক্তভোগী প্রবাসীরা জানান, শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার প্রতিবাদ ও দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার জন্য তারা আন্দোলন করে আজ নিজেরাই মহাবিপদে। আটকদের মুক্তি ও ইমিগ্রেশনে তাদের আটকানোর বিষয়টি যদি কূটনীতিকভাবে সমাধান না হয়, তাহলে জুলাই আন্দোলনের দায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রবাসী ও তাদের পরিবার।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম কধুরখীল গ্রামের শহীদুল আমিন মুন্নার স্ত্রী রোজিনা আক্তার আমার দেশকে জানান, অক্টোবরের ২৪ তারিখ দেশে আসার উদ্দেশে তার স্বামী আবুধাবি বিমানবন্দরে আসেন। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় মুন্নাকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি জুলাইয়ের সেই আন্দোলনকারীদের মিছিলে ছিলেন।

রোজিনা বলেন, ‘আমার স্বামী তো নিজের জন্য মিছিল করেনি। দেশ ও ছাত্রদের জন্য করেছিল। তাহলে আমার স্বামীর মুক্তিতে কেন সরকার নীরব?’ তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এক ফোনে যদি ১৮৯ জনের সাজা মওকুফ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমার স্বামী আলাদা কী এমন অপরাধ করলেন যে, তার জন্য ফোন বা অনুরোধ করা যাবে না?

 

আমিরাতে জেলেবন্দিদের একজন মৌলভীবাজারের বরলেখা উপজেলার ডিমাই গ্রামের ফরহাদ আহমদ। তার বাবা আজির উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে আজ আজ মাস ধরে গ্রেপ্তার। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তাদের খোঁজ নিচ্ছে না। কেউ গিয়ে দেখাও করছে না। অথচ দেশ ও জনগণের জন্য আমার ছেলে আন্দোলন করেছে নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে।’

 

জুলাই আন্দোলনে জেলবন্দি প্রবাসী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছগির তালুকদার বলেন, জেলেবন্দি এই প্রবাসীদের নিয়ে যতবারই আন্দোলন করেছি, ততবার প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আমাদের আশ্বস্ত করেছেন তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। তা সত্ত্বেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি বলেন, আন্দোলন করার অপরাধে আমিরাতে কতজন প্রবাসী জেলে আছেন, তার সঠিক খবর ও তালিকা মন্ত্রণালয় জানে না।

 

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, সরকার কূটনৈতিকভাবে যত দ্রুত সম্ভব ইমিগ্রেশন থেকে এসব প্রবাসীর ডাটা মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে প্রবাসীদের ব্যাপক ক্ষতি হবে।

 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ডায়াস্ফোরা অ্যালায়েন্সের প্রস্তুতি কমিটির কো-অর্ডিনেটর দিলশানা পারুল বলেন, আমাদের কাছে এরকম তথ্য আছে যে, অনেক প্রবাসী জেলবন্দি ও আরব আমিরাতের সিআইডি অফিসে বন্দি আছেন। দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় যদি গুরুত্ব দিয়ে সঠিকভাবে তদারক না করে তাহলে সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল।

 

তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে প্রবাসে সক্রিয় ছিলেন এসব প্রবাসী। তাদের অর্জন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি কেন নীরব তা জানা নেই।

 

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে নিযুক্ত কাউন্সিলর (শ্রম-স্থানীয়) লুৎফুন নাহার নাজীম আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাদের মুক্ত করতে। আমাদের আশা ছিল গত কোরবানির ঈদের আগে মুক্ত করতে পারব। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় সম্ভব হয়নি।’

 

লুৎফুন নাহার আরো বলেন, ‘আমাদের কাছে ২০ জনের একটি তালিকা আছে। তবে সমস্যা হলো, আমিরাতের পুলিশ গ্রেপ্তার করলে অবগত করে না। এজন্য আমরা সঠিক হিসাব এবং কে কোথায় আছেন তা জানতে পারি না। তবে তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সঙ্গে দেখা করার একটা আবেদন আমরা পাঠাব আমিরাতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর আশা করা যায় খুব দ্রুত আমরা তাদের মুক্ত করতে পারব।’

 

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব সারওয়ার আলম আমার দেশকে বলেন, ‘আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ তার দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এখানে আলাদাভাবে মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকে না। কয়েক মাস কারাভোগ করার পর ছেড়ে দেবে। তবে আমরাও চেষ্টা অব্যাহত রাখব।’