Image description

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তবে এসকে সিনহা নামেই পরিচিত। ছিলেন দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তার দেশছাড়া কিংবা পদত্যাগ খুবই আলোচিত ছিল শেখ হাসিনার শাসনামলের ইতিহাসে। এ নিয়ে বইও লিখেছেন সিনহা। অবশেষে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে দেশ থেকে তাড়ানোর ঘটনা আপিল বিভাগে তুলে ধরেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। জানিয়েছেন পেছনের কারণও।

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সকালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রিভিউ শুনানি শুরু হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চে শুনানির সময় ঘটনাটি তুলে ধরেন এই আইন বিশেষজ্ঞ।

শিশির মনির বলেন, ‘‘অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি ও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলার রায় ঘিরে এসকে সিনহাকে অসুস্থ বানিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। দেশের বাইরে পাঠানোর পর তার বিরুদ্ধে হেভিয়ার্স কপার্স মামলা করা হয়। আমার সিনিয়র মরহুম অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রধান বিচারপতি কোথায়?’ তার জবাব ওই সময়ের রাষ্ট্রপক্ষ দিতে পারেনি।’’

তিনি বলেন, ‘‘বিচারপতি সিনহাকে সরিয়ে আদালতকে নিজেদের মনমতো বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আর এসব ঘটনা নিজের ‘ব্রোকের ডিম’ বইয়ে তুলে ধরেছেন বিচারপতি সিনহা।’’ মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা বাস্তবায়নের মধ্যেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিহিত বলে জানিয়েছেন সংবিধান ও ফৌজদারি বিষয়ক এই আইন বিশেষজ্ঞ।

জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এসকে সিনহাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিজিএফআইএর সাবেক প্রধান এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এই বিচারপতি। সিনহা জানান, তার বাসার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি কারো সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলারও সুযোগ দেননি গোয়েন্দারা।

বেসরকারি এক টেলিভিশনের সঙ্গে ভিডিও আলাপে এসকে সিনহা জানান, ঋণখেলাপিদের দায় মুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এ বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে গড়ায় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা-বিষয়ক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে। এরপর তাকে নিয়ে শুরু হয় সব ষড়যন্ত্র। এমনকি অসুস্থ না হলেও নিয়মিত পাঠানো হতো চিকিৎসক। পদত্যাগে চাপ দেন তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান।

বিদেশ যাওয়ার পর মামলা হয় সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। সাজাও হয়েছে আদালতে। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশে ফিরতে চান এসকে সিনহা। চালিয়ে যেতে চান আইনি লড়াইও।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।

এসব নির্দেশনা হলো-

  • সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।
  • বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা। আর বিচারিক কাজ করতে পারবেন না নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা।
  • সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী।
  • এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে।
  • সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।
  • রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবে।
  • সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।
  • বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না। এছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
  • জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।
  • জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।
  • এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।
  • জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। ২০০৫ সালেও এই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।