Image description

বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। সারা দেশে চার হাজার ৮৮৩টি ক্লাব তৈরির মাধ্যমে আট লাখ ৭৮ হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরীকে সুবিধা দেওয়ার কথা রয়েছে।

এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৩৪ কোটি টাকাই ধরা হয়েছে এসব কিশোর-কিশোরীর নাশতার খরচ হিসেবে! প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব আজ মঙ্গলবারের একনেক সভায় অনুমোদনের কথা রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১৮ সালের এপ্রিলে ৫৫১ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে প্রকল্পটি অনুমোদন করে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি শেষ হওয়ার লক্ষণই নেই। উল্টো ১১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদও আরো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। অর্থাৎ নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে আট বছরের বেশি।

আজ পরিকল্পনা কমিশনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে ১৫টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এ সভায় ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ের ১৫টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। কার্যতালিকায় থাকা ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’ স্থাপনের প্রকল্পটিও রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেকের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ সভায় এসব প্রকল্প অনুমোদনের কথা রয়েছে।

মূল অনুমোদিত প্রকল্পে মোট ব্যয় ছিল ৫৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সারা দেশে ৪ হাজার ৮৮৩টি ক্লাবে নাশতার খরচ হিসেবে ধরা হয়েছিল ২৩৪ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু সাত বছর পর প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে এ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন থেকে এ ব্যয় কমানোর পরামর্শ আসার পর আপ্যায়ন ব্যয় ৩৪ কোটি টাকা কমিয়ে ২০০ কোটি টাকায় প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ আজ অনুমোদন পেতে যাওয়া প্রস্তাবনায় প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশই যাচ্ছে নাশতার খরচে।

কিশোর-কিশোরীদের কী ধরনের নাশতা দেওয়া হয় এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মো. আলমগীর আমার দেশকে জানান, সারা দেশে আমাদের যেসব ক্লাব রয়েছে সেখানে বাচ্চাদের নাশতা দেওয়া হয়- এটি সে খরচ।

কী ধরনের নাশতা দেওয়া হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাচ্চাদের নাশতায় ডিম দেওয়া হয়। সঙ্গে বিস্কুট, কলাও দেওয়া হয়।

প্রকল্পটির অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যয় হচ্ছেÑ দৈনিক ভিত্তিতে জেন্ডার প্রমোটর, সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষদের বেতন বাবদ ১৮৯ কোটি টাকা। এ খাতের উপকারভোগী শিক্ষক ও প্রশিক্ষক ১০ হাজার ৮৬১ জন। মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২৮ শতাংশের বেশি এ খাতেই ব্যয় করা হচ্ছে। এসব কিশোর-কিশোরীর কারাতে প্রশিক্ষণে ব্যয় হচ্ছে ৮৪ কোটি টাকার কাছাকাছি। এক্ষেত্রে উপকারভোগী সাত লাখ ৩২ হাজারের বেশি। মোট ব্যয়ের সাড়ে ১২ শতাংশ এ খাতে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি ক্লাবে ফিল্ড সুপারভাইজারদের তিন হাজার টাকা ব্যয়সহ মোট ব্যয় হবে ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ক্লাবগুলোতে বই ও সাময়িকীর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি টাকা।

এ ধরনের প্রকল্পে আনুষঙ্গিক অন্য ব্যয়ের তুলনায় নাশতা খাওয়ানোর ব্যয় সবচেয়ে বেশি রাখা কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সানজিদা আখতার আমার দেশকে বলেন, যেকোনো প্রকল্পে এ ধরনের ফাঁকফোকর আছে। যদি নাশতা খাওয়ানোর ব্যয়ই ২০০ কোটি টাকা থাকে, তাহলে সেটি অবশ্যই অনুচিত। প্রকল্পের ব্যয় ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজানো উচিত। এটি নিন্দনীয়।

তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজগুলোকে রিডিজাইন করা যেতে পারে। যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল, কোন খাতে কত খরচ হয়েছে, কোথায় কোন কাজ হয়েছে সেগুলো অবশ্যই বিশ্লেষণ করার দাবি রাখে। আমাদের দেশের গবেষকরা এগুলো মূল্যায়ন করে থাকেন, তারাও কাজ করতে পারেন।

প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রান্তিক কিশোর-কিশোরীদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সক্ষম করা। তাছাড়া সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স প্রতিরোধও এ প্রকল্পের আরেকটি উদ্দেশ্য। এসব ক্লাবে বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে এতে।

অধিদপ্তর বলছে, এটি বাস্তবায়ন হলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (এসআরএইচআর) এবং জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স (জিবিভি) বিষয়ক ঝুঁকি হ্রাস করা যাবে। এজন্য ১০-১৯ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স কমানোর লক্ষ্যে অনুকূল ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার ৯৫২ জন নারী উদ্যোক্তা তৈরি করাও আরেকটি উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের সামাজিক প্রকল্প নেওয়া হয় মূলত লোকদেখানো। সাধারণত যেসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে লক্ষ্য অর্জনের কোনো পরিসংখ্যান দেখা যায় না। ২০১৮ সালে নেওয়া আলোচ্য প্রকল্পটির সামান্য বাস্তবায়ন হলেও বাল্যবিয়ের হার কমতো। কিন্তু সরকারি জরিপের তথ্যই বলছে, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। দেশে প্রতি বছর স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) জরিপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ‍ব্যুরো (বিবিএস)। সর্বশেষ ২০২৩ সালের এসভিআরএস জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ওই বছর ১৫ বছরের কম বয়সিদের বাল্যবিয়ের হার বেড়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরও যা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০২১ সালেও ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। একই সময়ে ১৮ বছরের কম বয়সিদের বাল্যবিয়ের হারও বেড়ে ৪১ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যেটি ২০২২ সালেও ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে ড. সানজিদা খাতুন বলেন, শুধু প্রকল্পের কারণে যে বাল্যবিয়ে কমছে না, তা নয়। প্রকল্প একটি মাধ্যম হতে পারে। এটাতে স্বল্প মেয়াদে, মধ্য মেয়াদে ও দীর্ঘ মেয়াদে তাদের পরিকল্পনা থাকতে পারে। সব সময় বাল্যবিয়ে দরিদ্র পরিবারের মধ্যেই হয় তা নয়, এটি মধ্যবিত্ত পরিবারেও প্রবলভাবে হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশের সরকারি প্রকল্পগুলো ছাড়াও বেসরকারিভাবে জেন্ডার ভায়োলেন্স ও বাল্যবিয়ে কমানোর কাজ করছে। বাল্যবিয়ে সাধারণত একটি বা দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেওয়া কঠিন।