
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আলোচনায় বিচার বিভাগ সংস্কার। এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন। বিচারকদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। তবে এ উদ্যোগ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের রয়েছে মতভেদ। সংস্কার বাস্তবায়নের আগেই কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিশনকেই অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১১ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটি। এ লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের দুই হাজার বিচারককে নিয়ে বিশেষ সভা করেন। বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিতে কয়েক দফায় নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি নিয়োগের আগে কোনো আইন ছিল না। দীর্ঘদিন সিম্প্যাথির ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ হতো। এখন প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে একটি আইন হয়েছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা বৈষম্যমূলক।- ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন
বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার বাইরে বিচারকদের সংগঠনও এগিয়ে এসেছে ১২ দফা প্রস্তাব নিয়ে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন, মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা বাস্তবায়ন, বাজেট প্রণয়নে সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা, বিচারকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন, জনসংখ্যা ও মামলা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, পৃথক আদালত গঠন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিচারকদের জন্য নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবির পাশাপাশি, জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোতে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে। তবে এসব সংস্কার উদ্যোগের বাস্তব রূপ পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
প্রথমে সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো, কিন্তু এরপর বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা হলো—এটা আসলে সরকার কমিশনকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই মনে হচ্ছে। তারা চাইলে সংস্কারের ভিত্তিতেই নিয়োগসংক্রান্ত আইন আনতে পারতো।- সুপ্রিম কোর্ট বারের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব
বিশ্লেষকদের মতে, সংস্কার কমিশনের কার্যকর ভূমিকা না থাকলে এ উদ্যোগ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। কেউ কেউ মনে করেন, গুরুত্বপূর্ণ এ কমিশনে যোগ্য ও অভিজ্ঞ বিচারপতিদের না রেখে অযোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
সব মিলিয়ে বিচার বিভাগীয় সংস্কারের লক্ষ্যে নেওয়া এ উদ্যোগ সময়োপযোগী হলেও, তা কতটা কার্যকর হবে— তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও আন্তরিকতার ওপর। কারণ অতীতেও অনেক ভালো উদ্যোগ ছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের অভাবে হারিয়ে গেছে।
স্বাধীন বিচারব্যবস্থা হলে দেশ শক্তিশালী হবে
আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ অতীতে নির্বাহী বিভাগের (এক্সিকিউটিভ) নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিচারকদের মধ্যে সব সময় এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করতো। বিচারকরা ভাবতেন যদি আমি ন্যায়বিচার করি, তাহলে কখন না জানি আমার চাকরি চলে যায়, পরিবার বিপদে পড়ে, কিংবা আমাকে বদলি করে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টেও একই পরিস্থিতি ছিল। কথা না শুনলে ভালো বেঞ্চ থেকে সরিয়ে একক বেঞ্চে দেওয়া হতো। বাদ দেওয়ার এ আতঙ্ক বিচারকদের মানসিকভাবে অবসন্ন করে রাখতো।’
আমি যে সব সংস্কারের কথা বলি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই আলাদা সচিবালয় দরকার। এটি প্রধান বিচারপতির অধীনে আনতে হবে।- মনজিল মোরসেদ
তিনি বলেন, ‘বিচারকের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য যে মানসিক সমর্থন প্রয়োজন, সেটা তখন ছিল না। যদি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, ইনশাআল্লাহ উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতের বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন।’
গণতন্ত্র না থাকায় বিচার বিভাগের দুর্বলতা বেড়েছে উল্লেখ করে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘যখন দেশে গণতন্ত্র ছিল না, তখন বিচার বিভাগ থেকেও তেমন কিছু বলা হতো না। এর মূল কারণ ছিল এক্সিকিউটিভের কর্তৃত্ব। আবার কেউ কেউ সরকার চলে যাওয়ার পর বা পরিবর্তনের পর কথা বলতেন। আমরা চাই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক এবং বিচারহীনতা দূর হোক।’
বিচার বিভাগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের দফায় দফায় প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির দেওয়া ১২ দফা কর্মসূচি অত্যন্ত সময়োপযোগী। যদি এ কর্মসূচির আলোকে বিচার বিভাগ এগিয়ে যায়, তাহলে তা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’
বিচারকের মাপকাঠি হবে মেধা, সততা ও ব্যক্তিত্ব
ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বিচারপতি নিয়োগের আগে কোনো আইন ছিল না। দীর্ঘদিন সিম্প্যাথির ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ হতো। এখন প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে একটি আইন হয়েছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা বৈষম্যমূলক। যিনি বিচারপতি হবেন, তাকে অবশ্যই মেধাবী, যোগ্য, সৎ এবং চরিত্রবান হতে হবে। বিচার বিভাগের দুটি ডানা, এর একটি বিচারক, অন্যটি আইনজীবী। অথচ এই বিচার বিভাগীয় সংস্কারের আলোচনায় আইনজীবীদের যথাযথ জায়গা নেই, এটা দুঃখজনক।’
দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ নয়
বিচার বিভাগ সংস্কার ও বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যে ধরনের বিচার বিভাগ সংস্কার চেয়েছিলাম, সেখানে কিছু বিষয়ের জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। এসব উদ্যোগ প্রধান বিচারপতি নিজেই নিতে পারেন সরকারের সহযোগিতায়। প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কারে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ১২ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আশা করেছিলাম, উদ্যোগগুলো সরকারের সহযোগিতায় দ্রুত বাস্তবায়ন হবে এবং কিছু কিছু পদক্ষেপ প্রধান বিচারপতি নিজেও নিতে পারবেন।’
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানেও আমরা দীর্ঘসূত্রতা দেখতে পাচ্ছি। যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। ফলে কিছু মানুষ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিচারক হতে চাইছে দলীয় বিবেচনায়। এটা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসা দরকার।’
উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ নিয়োগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। উচ্চ আদালতের একাধিক বিচারককে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও এক-দুজনের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এভাবে বিচারপতিদের ঝুলিয়ে রাখা বিচার বিভাগের জন্য অস্বস্তিকর।’
‘অবজ্ঞা’ করে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব।
তিনি বলেন, ‘কমিশনের সুপারিশ দেওয়ার আগেই সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তার গুরুত্ব খর্ব করেছে। যদি সত্যিকার অর্থেই সংস্কারের উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে বিচারক নিয়োগের আগে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার সেটি না করে আগেভাগেই বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ দিয়েছে। এভাবে সংস্কার কমিশনকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এটি যেন একটি রাজনৈতিক খেলা— যেমনটি আমরা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও দেখেছি।’
সৈয়দ মামুন মাহবুব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রথমে সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো, কিন্তু এরপর বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা হলো—এটা আসলে সরকার কমিশনকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই মনে হচ্ছে। তারা চাইলে সংস্কারের ভিত্তিতেই নিয়োগসংক্রান্ত আইন আনতে পারতো।’
কমিশনের সদস্য নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সাবেক বিচারপতি শাহ্ আবু নাইম মুমিনুর রহমানকে— তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন, বারের সিনিয়র সদস্য ছিলেন, তাকে সম্মান জানাই। তবে যাদের কমিশনের সদস্য করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই অযোগ্য। বহু যোগ্য ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, দেশের সব জ্ঞান কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনে সীমাবদ্ধ। আইন অনুষদের বাইরে তিনি কিছু দেখেন না। এই মনোভাব থেকেই অনেক ভুল প্রস্তাব এসেছে, যেগুলো কমিশনের মানহানিকর।’
তবে কিছু সাহসী প্রস্তাবের প্রশংসা করে সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ‘আমি বিচারপতি শাহ্ আবু নাইম মুমিনুর রহমানের একটি সাহসী প্রস্তাবের কথা বিশেষভাবে বলবো— তিনি বলেছেন, বারকে (আইনজীবী সমিতি) রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, কোনো রাজনৈতিক দলের আইনজীবী সংগঠন থাকা যাবে না। এ প্রস্তাব অত্যন্ত সময়োপযোগী।’
বিচার বিভাগীয় সংস্কার বহু পুরোনো দাবি
বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কারের দাবি আজকের নয়। বহুদিন ধরেই আইনজীবী সমাজ ও সুশীল সমাজ এ বিষয়ে আলোচনা ও দাবি জানিয়ে আসছে। এখন যে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেটি ভালো উদ্যোগ, তবে এটি কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কারের দাবি এতটাই সুপ্রতিষ্ঠিত যে আদালত পর্যন্ত রিট হয়েছে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন নিয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে—কাদের কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণে নিয়ম থাকা দরকার।’
সংস্কার কমিশন গঠনে সময় ও বাস্তবতা বিবেচনায় ঘাটতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কমিশনে যাদের রাখা হয়েছে, তারা হয়তো এক সময় বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু বহু বছর ধরে তারা আর সক্রিয়ভাবে যুক্ত নন। বিশেষ করে কমিশনের নেতৃত্বেই যারা আছেন, তাদের কাছে গত ১০–২০ বছরের বাস্তব ও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা নেই। সে কারণে কমিশনের সুপারিশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে গেছে।’
বিচার বিভাগ স্বাধীন রাখতে প্রয়োজন আলাদা সচিবালয়
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আমি যে সব সংস্কারের কথা বলি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে হলে অবশ্যই আলাদা সচিবালয় দরকার। এটি প্রধান বিচারপতির অধীনে আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে সচিবালয়ের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের বিচারকদের পোস্টিং ও ট্রান্সফার হয়, সেটাই বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার প্রধান কারণ।’
বিচারক নিয়োগ আইনের বর্তমান গঠনে আপত্তি জানিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘যদিও এখন বিচারক নিয়োগের আইন হয়েছে, আমি সেই আইনের গঠনে একমত নই। আইনটি করা উচিত ছিল এমনভাবে যাতে অ্যাটর্নি জেনারেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে দুজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা বর্তমান বিচারপতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হতো।’
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া জরুরি
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আপিল বিভাগ ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ কীভাবে হবে তা নিয়েও সংস্কার দরকার। এখন ইচ্ছামতো এই নিয়োগগুলো হয়। যেমন কিছু রাজনৈতিক দল দাবি করে, যেন সর্বোচ্চ দুজনের মধ্য থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি বেছে নেবেন। আমি এই মতের পুরোপুরি বিরোধিতা করি। কারণ আপনি যখন সরকারকে চয়েস দেবেন, তখনই বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হবে।’
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে তিনি বলেন, চিফ জাস্টিস হবেন সেই ব্যক্তি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি। যদি তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি বা অযোগ্যতার অভিযোগ না থাকে, তবে তাকেই নিয়োগ দিতে হবে। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি থাকবেন, তারপর এখানেও যদি নিয়োগ কমিটি বা কাউন্সিল করে দেওয়া যায় তা হলে ভালো।
আইনজীবীদেরও সংস্কার লাগবে
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিচার বিভাগের শুধু বিচারকদের বিষয়ে সংস্কার করলেই হবে না। এর বাইরে আইনজীবীদেরও সংস্কার লাগবে। আইনজীবীরা হলেন জুডিশিয়ারির একটা পার্ট এবং প্রশাসন হলো জুডিশিয়ারির একটা পার্ট। দুই জায়গায় সংস্কার করতে হবে।’
বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অনৈতিকতা ও শৃঙ্খলাভঙ্গ নিয়ন্ত্রণে একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের দুর্নীতি রোধ করতে হলে ‘জুডিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’ গঠন করা জরুরি। এটি হবে প্রধান বিচারপতির অধীনে এবং এর জন্য আলাদা একটি অফিস থাকবে।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি
মনজিল মোরসেদ বলেন, বর্তমানে দেশে নির্বাচিত সরকার নেই, সংসদ নেই। তবুও এখনই একটি আইন করা দরকার—কীভাবে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ হবে। এজন্য একটি গাইডলাইন থাকতে হবে, যাতে শুধু সিনিয়র ও যোগ্য বিচারকরাই এই নিয়োগ পান।
তিনি আরও বলেন, চিফ জাস্টিস নিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি সুনির্দিষ্ট কমিটি থাকা দরকার, যাতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র ও যোগ্য বিচারপতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিফ জাস্টিস হন। আর একটা হলো সচিবালয় আলাদা করা দরকার। তা না হলে নিম্ন আদালতের বিচারকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে না।
বিচারক নিয়োগের আইন সংশোধনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর তার পক্ষের রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল থাকেন। তিনি বিচারক নিয়োগ কমিটিতে থাকলে নিয়োগ করবেন রাজনৈতিকভাবে। অতএব অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি (সাবেক অথবা বর্তমান) নিয়ে বিচারক নিয়োগ কমিটি করা যেতে পারে।