
ক্যাম্পাসে এখন আলোচনায় তুঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। যদিও নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। তবে গত ১৬ জুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় ডাকসু নির্বাচন গুরুত্ব পাচ্ছে। ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রস্তুতি চলছে বহুদিন ধরেই। ফলে নির্বাচন কমিশন গঠনের খবরে ভোটকেন্দ্রিক তোড়জোড় আরও বেড়েছে।
১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন পর্যন্ত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯ বারই হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ৫০ বছরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৩ বছরে মাত্র আটবার ডাকসু নির্বাচন দেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বছর খানেক আগেও ক্যাম্পাসে সাবেক সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) একচ্ছত্র অধিপত্য ছিল। তাই ডাকসু নির্বাচনের আলোচনা ছিল উপেক্ষিত। তবে গতবছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্রনেতা বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
রোববার (২২ জুন) ডাকসু নির্বাচন কমিশনের প্রথম সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সভায় প্রতিটি ধাপে নির্বাচন কমিশনের করণীয় পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। ডাকসু নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেছেন, ডাকসু খুব দ্রুত আয়োজন করতে হবে। ডাকসু আয়োজনে ১০ ভাগের ৮ ভাগ কাজই সম্পন্ন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্রশিবির এরই মধ্যে কিছুটা হলেও কেন্দ্রীয় প্যানেল গঠন করেছে। তবে ছাত্রদল এখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। আবার অনেক ছাত্রসংগঠন সম্মিলিতভাবে একটি প্যানেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী ‘স্বতন্ত্র’ প্যানেল গঠনের পরিকল্পনাও করেছেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ কেন্দ্রীয় প্যানেল ও নির্বাচন পরিকল্পনা শেষ দিকে
জুলাই আন্দোলনের সূত্র ধরে নবগঠিত ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ কেন্দ্রীয় প্যানেল ও নির্বাচন পরিকল্পনা প্রায় শেষ দিকে এনে ফেলেছে। দলটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের ভিপি এবং কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আবু বাকের মজুমদার জিএস পদে প্রার্থী হবেন এটা মোটামুটি ফাইনাল। সংগঠনটি নিজ দলের বাইরেও প্যানেলে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র উপযুক্ত প্রার্থীকে রাখার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে আব্দুল কাদের সারাবংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করছি। যাতে আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং ছয় থেকে সাতজন নারী শিক্ষার্থীও প্রতিনিধিত্ব পায়।’
ছাত্রদল চায় ‘প্রশাসনিক সংস্কারের’ পর নির্বাচন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন ক্যাম্পাস নিরাপদ রাখতে ব্যার্থ। তাই এ প্রশাসনের আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাম্য হত্যাকাণ্ডের পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। শুধু সাম্য হত্যা নয়, আমরা অতীতে যতগুলো ব্যর্থ ঘটনা রয়েছে সেগুলোকে সামনে এনে বিশেষ করে গত দেড় দশকেও যেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি সেগুলো নিয়ে বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ড, চারুকলায় ফ্যাসিস্টের মোটিভ পোড়ানো, গণিত ভবনের সামনে ঝুলন্ত লাশ, হাসিনার ছবি সংবলিত ঘৃণা স্তম্ভ রাতের আঁধারে মুছে দেওয়া- এ ধরনের নানান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের পদত্যাগ চেয়েছি। সর্বশেষ ছাত্রদল নেতা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন যোদ্ধা সাম্যকে যখন আমরা হারালাম এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ রাখার কথা বলেছে প্রশাসন। তবে আমরা ঈদুল আযহার পরেই দেখলাম ঢাবি ক্যাম্পাসে ককটেল মজুদ অবস্থায় পাওয়া গেল, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্যাম্পাসের পাশে মিছিল করে, ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতগুলো ঘটনার ব্যার্থতাই প্রশ্নটা সামনে আনে যে এই প্রশাসন সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে কি না? আমরা দাবি, প্রশাসন তাদের ব্যর্থতাগুলো শুধরে নেবে। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হলে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেবে।’
অভ্যন্তরীণ প্যানেল প্রায় চূড়ান্ত ছাত্রশিবিরের
ঢাকা ছাত্রশিবিরের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে ডাকসু গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে। নতুন পদ সৃষ্টি, প্রার্থীতায় বয়সসীমা তুলে দেওয়াসহ কিছু বিষয়ে ছাত্রদলের সুপারিশকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। এ ছাড়া, নির্বাচন কমিশনে শিক্ষকদের একটি বিশেষ দলের আধিক্য রয়েছে বলে অভিযোগ করছে দলটি। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ প্যানেল অনেকটাই চূড়ান্ত। তফসিল ঘোষণার পর প্যানেল প্রকাশ করবে তারা। হল পর্যায়ে তারা কোনো প্যানেল দেবে না। কর্মী-সমর্থকরা সেখানে স্বতন্ত্র অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে; তাদের সমর্থন দেবে সংগঠনটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের মধ্যে প্যানেল গুছিয়ে নিয়েছি। হলে আমাদের কমিটি নেই বলে প্যানেল দেওয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে যারা হলে কাজ করছেন, তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন।’
‘সম্মিলিত প্যানেল’ ঘোষণা করবে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও প্ল্যাটফর্ম
সাতটি বাম ছাত্রসংগঠনের মোর্চা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট’ যৌথভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। একাধিক বামপন্থী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ছোট ছাত্রসংগঠনগুলো ও ক্যাম্পাসের কিছু কিছু স্বতন্ত্র সক্রিয় ব্যক্তি মিলে সম্মিলিত প্যানেল দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এদের কেউ কেউ এরই মধ্যে প্যানেল গঠন করেছেন, আবার কেউ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নারী সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র ও ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উমামা ফাতেমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ করে দিতে ডাকসুতে একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
ক্যাম্পাসে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’দের ব্যানারে নিয়মিত বিভিন্ন আন্দোলন ও কার্যক্রমে আলোচিত নাম ২০২১-২০২২ সেশনের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক ইবনে আলী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি আছে আমাদের। তফসিল হলেই প্যানেল ঘোষণা করা হবে।’
নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার নির্বাচন কমিশনের
ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা এখানে আছি (নির্বাচন কমিশন) সবাই দল-মত নির্বিশেষে নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করব। এখানে আমরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষার্থে সবাই একসঙ্গে কাজ করব। এখানে দলীয় কোনো পরিচয় থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের সময় সম্পর্কে এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা নির্বাচন কমিশন আলোচনা করে জানাবে। তবে প্রথম আনুষ্ঠানিক সভায় আমরা আলোচনা করব প্রতিটি ধাপে আমাদের করণীয়গুলো কী হবে তা নিয়ে।’
সারাবাংলা