
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ঢাকার আকাশে তখন হেলিকপ্টারের গর্জন, মাটিতে ছাত্র-জনতার গগনবিদারী স্লোগান আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টিয়ারশেল ও গুলির শব্দ। সেই দিন রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়ার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন নোয়াখালীর তরুণী নাছিমা আক্তার (২৪)। আর বুক ছিদ্র হয়ে গুরুতর আহত হন তার ভাতিজা, ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী আইমান উদ্দিন (২০)। এক বছর হতে চললেও এখনও সেই দিনের কথা ভুলতে পারেনি আইমান।
আইমান উদ্দিন নোয়াখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড মাইজদী বাজার এলাকার স্পেন প্রবাসী হেলাল উদ্দিন সোলায়মানের বড় ছেলে। সে গেল বছর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। অন্যদিকে নিহত নাছিমা আক্তার স্পেন প্রবাসী হেলাল উদ্দিনের ছোট বোন। কিছুদিনের জন্য বেড়াতে ঢাকায় গিয়েছিলেন নাছিমা। মৃত্যুর আগে তার বিয়ের আলাপ চলছিল। কিন্তু মেহেদী রাঙানোর সৌভাগ্য আর হয়নি নাছিমার।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড় ও আশপাশের এলাকাজুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সরাসরি গুলির ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডের একটি ভবনের ছাদে উঠেছিলেন নাছিমা আক্তার, তার ভাতিজা আইমান উদ্দিন ও সায়মন উদ্দিন। তখন হঠাৎ করে একটি হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি তাদের গায়ে বিদ্ধ হয়।
সেই গুলিটি প্রথমে আইমানের বুকের ডান পাশে ঢুকে, শরীর ভেদ করে পেছনে থাকা ফুফু নাছিমার গলায় ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলেই তারা দুজন রক্তাক্ত হয়ে পড়লে, স্থানীয়রা দ্রুত তাদের রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যান।
নাছিমা আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউতে, যেখানে এক রাত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পরদিন বিকেলে তিনি শহীদ হন। মৃত্যুর আগেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু জীবনে আর সেই মেহেদীর রঙ দেখা হয়নি নাছিমার। অন্যদিকে আইমান ছিলেন ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরে ৫ আগস্ট ছাড়পত্র পেয়ে বাসায় ফেরেন, তবে তার বুকে এখনো গুলির ক্ষত ও মানসিক ট্রমা রয়ে গেছে।
আইমান বলেন, জুলাইয়ের ওই ট্রমাগুলো এবং আমার পরিবারের ওপর যে ঝড় বইছে তা এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সেদিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। শেষবার মাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে শঙ্কামুক্ত হলে ৫ আগস্ট ছাড়পত্র পাই। এর আগে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সায়েন্স ল্যাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। হাসপাতালে প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল পরিবারের। এখন শারীরিকভাবে পুরোপুরি ফিট না। এখনো বুকে খুব ব্যথা পাই।
আইমানের মা রেহানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনা শুনেই আমি চিৎকার শুরু করি। আশপাশের মানুষ এসে আমার ছেলে ও ননদকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তখন বলছিল, আমার ছেলে বাঁচবে না। আমি ভেঙে পড়েছিলাম। তখন চারদিকে ইন্টারনেট বন্ধ, কোথাও যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অনেক চেষ্টা করে আমার ছেলেকে বাঁচানো গেলেও আমার ননদকে হারাতে হলো।
আইমানের বাবা হেলাল উদ্দিন সোলায়মান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন বা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন যারা অনেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। আমরাও কিছু পেয়েছি। কিন্তু আমরা অনেক জায়গায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছি, হয়রানির শিকার হচ্ছি। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ডেথ সার্টিফিকেট আছে, তাদের সব কাগজপত্র, ডকুমেন্টস অনলাইনে আছে। সব থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো কাজে যাই তখন বলা হয় এই কাগজ লাগবে, ওই কাগজ লাগবে। এটা দিলে বলে ওটা লাগবে। এতে ব্যাপক হয়রানি হতে হচ্ছে। আমরা চাই যে, কেউ যাতে এরকম হয়রানির শিকার না হয়। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়া আমার ছোট বোনের সঞ্চয়পত্র আমরা এখনো পাইনি।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আখিনূর জাহান নীলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহীদ নাছিমার সঞ্চয়পত্র সবার আগে তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরিবার একাউন্টের তথ্য পরিবর্তন করায় হস্তান্তর করা হয়নি। খুব দ্রুতই হস্তান্তর করা হবে। অন্যদিকে আইমানকে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন এক লাখ টাকা দিয়েছে অনেক আগে। তার কোনো আবেদন না থাকায় আমরা সুযোগ সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি। আশা করি খুব দ্রুতই তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।