
একসময় যত দূর চোখ যেত, পাথর আর পাথর দেখা যেত। এখন সেখানে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত আর ধু–ধু চর। বছরের পর বছর ধরে লুটতরাজের কারণে পাথরসাম্রাজ্য সিলেটের কোয়ারি ও নদ-নদীগুলো এখন প্রায় পাথরশূন্য। বিশেষ করে গত ১০ মাস প্রকাশ্যেই লুট হয়েছে। এর নেপথ্যে বিএনপি ও এর অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের নেতারা রয়েছেন।
স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে পাথর লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাজার হাজার মানুষ পাথর কোয়ারি আর নদ-নদী থেকে নির্বিচার পাথর লুটপাট করছেন। অথচ প্রশাসন তা ঠেকাতে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না।
গত শনিবার সকালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলং এলাকা পরিদর্শনে গেলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের গাড়িবহর আটকে দেন বালু-পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। এসব আন্দোলনকারীর নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের কয়েকজন নেতা। এ সময় তাঁরা বন্ধ থাকা জাফলংসহ সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো চালুর দাবিতে স্লোগান দেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুই উপদেষ্টার নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই গত সোমবার সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুলে ৩০টি ও জৈন্তাপুরে ৫টি মেশিনে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গতকাল মঙ্গলবারও সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুলে ৩৩টি ক্রাশার মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধে নির্দেশনা দেয় সরকার। এর পর থেকে রাতের আঁধারে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন চলত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন শুরু করেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইজারা স্থগিত রাখা কোয়ারির অধিকাংশই সিলেটে। এসব কোয়ারিভুক্ত এলাকা ছাড়াও গোয়াইনঘাটের পিয়াইন নদ এবং কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদ, সাদা পাথর ও সংরক্ষিত বাংকার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচুর ছোট-বড় পাথর রয়েছে। পাশাপাশি গোয়াইনঘাটের পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলংও পাথরের সাম্রাজ্য হিসেবে সুপরিচিত। মূলত এসব এলাকার পাথরই অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে।
দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ, সিলেট জেলায় মোট পাথর কোয়ারি রয়েছে আটটি। এর বাইরে আরও অন্তত ১০টি জায়গা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। বিগত ১৫ বছরে যা লুটপাট হয়নি, গত ১০ মাসে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লুটপাট হয়েছে বলেও তাঁরা দাবি করেছেন।
তবে গত ১০ মাসে কী পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, এর কোনো পরিসংখ্যান প্রশাসনের কাছে নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, সিলেটের পাথর কোয়ারি ও কোয়ারিভুক্ত এলাকা ছাড়া অন্যান্য স্থান থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। লুটপাট অব্যাহত থাকায় কিছুদিনের মধ্যেই সিলেট পাথরশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিন-রাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল আর টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করেন। হাজার হাজার বারকি নৌকায় সেসব পাথর বহন করে এনে তাঁরা মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করেন। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ওই ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম প্রথম আলোকে বলেন, বিগত দেড় দশকে সিলেটে যে পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে, এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লুটপাট হয়েছে গত ১০ মাসের ব্যবধানে। এ নজিরবিহীন লুটপাট অতীতে দেখা যায়নি। অথচ প্রশাসন লুটপাট ঠেকাতে ব্যর্থ। কোয়ারির ইজারা বন্ধ আছে; কিন্তু লুটপাট অব্যাহত আছে, তাহলে লাভ কী হলো? প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থে এ লুটপাট যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে।
ম্লান সাদা পাথরের সৌন্দর্য
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা দেশ-বিদেশে সুপরিচিত। উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও বাংকার এলাকায় পাথর লুটপাটের পর গত ২৩ এপ্রিল থেকে চক্রটি সাদা পাথর এলাকায় লুট শুরু করেছে। এরই মধ্যে এলাকাটি প্রায় পাথরশূন্য করে ফেলা হয়েছে। গত শনিবার রাতেও এখানে দেদার পাথর লুট হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে এ পর্যটনকেন্দ্র। ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলের স্রোতোধারা এই পর্যটনকেন্দ্রের মূল আকর্ষণ। এই সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক ভিড় জমান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধলাই নদের উৎসমুখ সাদা পাথরের মূল অংশ থেকে পাথর লুট করে নেওয়ায় পর্যটনকেন্দ্রটি অনেকটা শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। পাথর না থাকায় প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হলেও ‘জল-পাথরের স্রোতোধারা’র সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় পর্যটকেরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

নেপথ্যে বিএনপি নেতারা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জে বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী বালু ও পাথর লুটপাটে জড়িত। এর মধ্যে জাফলংয়ে বালু-পাথর লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১৪ অক্টোবর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরানের দলীয় পদ স্থগিত করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। ৯ জুন জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেমকে বহিষ্কার করা হয়।
সর্বশেষ গত শনিবার দুপুরে পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে জাফলংয়ে পরিবেশ ও খনিজসম্পদবিষয়ক দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে যে বিক্ষোভ হয়, সেখানে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতৃত্ব দেন। বিক্ষোভে নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সুমন শিকদার, গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান, জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল জলিল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম ও ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রমজান মোল্লা। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় যুবদল গত রোববার জাহিদ খানকে বহিষ্কার করেছে।
১০ মামলায় আসামি ২৬৬, গ্রেপ্তার ১
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের ঘটনায় ৯টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২২৬ জনকে। এর মধ্যে জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম গত ২৭ এপ্রিল সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তবে ঈদের আগে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা কর্তন ও পাথর উত্তোলনের অভিযোগে ২৩ জানুয়ারি ৪০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এ মামলায় কোনো গ্রেপ্তার নেই। জাফলংয়ে লুটপাটের ঘটনায় দায়ের করা ৯টি মামলার মধ্যে ৬টি বিচারাধীন ও ৩টি তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, পাথর উত্তোলনের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর একের পর এক মামলা করেছে; কিন্তু পুলিশ কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করেনি। বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক।
এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার মো. তোফায়েল আহমদ বলেন, গোয়াইনঘাটে দায়ের হওয়া ৯টি মামলার অন্তত ৯০ শতাংশ আসামিই জামিনে আছেন। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা করছে।

অভিযানেও থামেনি পাথর লুট
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ৫ আগস্টের আগে আড়ালে-আবডালে পাথর উত্তোলন চলত। ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে হাজারো মানুষ অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন শুরু করেন। টানা দুই মাস সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো নজরদারি ছিল না। এ সময়টাতে দেদার লুটপাট হয়। এরপর প্রশাসন অভিযান চালালে পাথর উত্তোলনকারীরা সটকে পড়ে। পরে অভিযানে আসা দলটি চলে গেলে আবার তারা উত্তোলন শুরু করে।
স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে ‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা’র সুযোগে পাথর লুটপাট বেশি হয়েছে। স্থানীয় ও বাইরের এলাকার হাজার হাজার মানুষ এসে সংঘবদ্ধভাবে লুটপাট চালাচ্ছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযান পরিচালনার সময় অন্তত ১০ বার পাথর উত্তোলনকারীরা সংঘবদ্ধভাবে পাথর ছুড়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ অভিযানকারী দলকে ধাওয়া দেয়।
নিয়মিত অভিযানসহ প্রশাসনের নানা উদ্যোগে অবৈধ পাথর উত্তোলন এখন অনেকটাই কমেছে বলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ দাবি করেছেন। তিনি জানান, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে ক্রাশিং মেশিনে এনে ছোট করা হতো। সেটি বন্ধে ক্রাশিং মেশিনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে।
ভোলাগঞ্জ ও জাফলং এলাকার তিনজন বাসিন্দা জানান, অভিযানের প্রভাব সামান্য সময়ই থাকে। এরপর আবারও দেদার লুটপাট চলে। হাজার হাজার মানুষ লুটপাটে যুক্ত থাকায় অনেক সময় কম লোকবল নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনও অভিযান চালাতে ভয় পায়।