
পালিত হলো বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। অথচ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য এটি যেন এক নির্মম পরিহাস। বিশ্বের মরুকরণ-প্রবণ অঞ্চলগুলোর মতোই তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা ক্রমেই পানিশূন্য ও প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারও আগে।
১৯৮৩ সালের সমঝোতায় বাংলাদেশকে ৩৬ শতাংশ এবং ভারতকে ৩৯ শতাংশ পানি বরাদ্দের কথা থাকলেও, বাস্তবে ভারত একতরফাভাবে নদীর উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে প্রায় সম্পূর্ণ পানি নিজেরাই দখলে রেখেছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনকে অগ্রাহ্য করে তিস্তার ৫৪টি জলকপাটের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সেচ প্রকল্পে।
২০২৩ সালের ২ মার্চ, ভারত বাংলাদেশের ৬০ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেচ বিভাগের অধীনে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আরও দুটি খাল খননের কাজ শুরু করেছে। রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলায় আরও বেশি জমিতে সেচের আওতায় আনবে। এর ফলস্বরূপ, তিস্তার পানি ভারতের দিনাজপুরের জলঢাকা নদীর (বাংলাদেশে যা ধরলা নদী নামে পরিচিত) সঙ্গে মিলিত হবে। এর ফলস্বরূপ, বর্ষাকালে ধরলায় দেখা দিতে পারে ভয়াবহ বন্যা, আর শুষ্ক মৌসুমে এটি পরিণত হতে পারে বিশাল মরুভূমিতে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পতন ও কৃষির মৃত্যু এক সময় সাত লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করা তিস্তা এখন আর ৪০ হাজার হেক্টর জমিতেও পানি দিতে পারছে না। ফলস্বরূপ, শ্যালো ও গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীলতা বহু গুণ বেড়েছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে ৩-৪ মিটার পর্যন্ত নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা অববাহিকার নদ-নদী যেমন করতোয়া, ধরলা, যমুনাশ্বেরী, কুমলাই, পুনর্ভবা শুকিয়ে গেছে। নদী হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে মাছ, নৌকার মাঝি এবং নদীভিত্তিক শত শত পেশাজীবী পরিবার। বন, কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্যের অবস্থাও ভয়াবহ। মরুকরণ এখন আর শুধু সাহারার গল্প নয়- এটি বাংলার নির্মম বাস্তবতা।
সাহারা মরুভূমির গবেষক ও মার্কিন ভূ-বিজ্ঞানী ড. নরম্যান ম্যাকলিয়ড বলেছেন, ‘সাহারাতে ঠিক যেভাবে একদিন মরুভূমির বিস্তার শুরু হয়েছিল, বরেন্দ্র এলাকায় ঠিক সেভাবেই বিপদটা শুরু হয়েছে।’ গজলডোবা বাঁধের কারণে তিস্তাসহ অনেক ছোট নদ-নদীতে বছরের প্রায় আট মাসই পানি থাকে না। নদীর পলি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে।
শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলার প্রকৃতি ও পরিবেশ রীতিমতো বদলে যাচ্ছে। একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের জীবন ও জীববৈচিত্র্যই কেবল ধ্বংস করেনি; বরং ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে এ দেশের কৃষি, শিল্প, বনসম্পদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য। অপ্রত্যাশিত বন্যার কারণে কোথাও কোথাও নদীর প্রশস্ততা ৪-৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছে।
গজলডোবা বাঁধ : এক মরণফাঁদ উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবজীবনের ওপর গজলডোবা বাঁধের প্রভাব এতটাই ভয়াবহ যে স্থানীয়রা একে ‘মরণ বাঁধ’ বলে আখ্যায়িত করছে। এটি শুধু পানি আটকে রাখছে না; এটি ধ্বংস করছে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং মানুষের জীবিকা। এর ফলে তিস্তার বাংলাদেশ অংশ ধীরে ধীরে তার প্রাণশক্তি হারাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মরুকরণ রোধে করণীয় বিশ্বব্যাপী যখন মরুকরণ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজের ডাক দেওয়া হচ্ছে, তখন আমাদের করণীয় হতে পারে : উজানের কোনো দেশ ভাটির দেশকে না জানিয়ে আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার করা জাতিসংঘ কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ ভারত প্রথম থেকেই ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এই কাজটি করে যাচ্ছে। এক্ষণে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের করণীয় হলো :
১. ব্যাপক জনমত ও জাতীয় ঐক্য গঠন : গজলডোবার অশুভ প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক জনমত এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা অপরিহার্য। কাদা ছোড়াছুড়ির বিভেদাত্মক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় স্বার্থে সরকার, বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এ সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি উপস্থাপন : গজলডোবার কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়-ক্ষতির কথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের দ্বারস্থ হওয়া উচিত। এটি কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, এটি আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘনের একটি বড় উদাহরণ।
৩. আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার : চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পানি সমস্যার সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা। একই সঙ্গে, এ লক্ষ্যে 'আঞ্চলিক নদী কমিশন' গঠন করা এবং আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারের নিয়ম-নীতির বাস্তব প্রয়োগ ও তদারকি করা।
৪. ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ : দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করা, যাতে ভারত তার নবপরিকল্পিত একতরফা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ বাতিল করে। এই ধরনের প্রকল্প পরিবেশগত ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করতে পারে।
৫. কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। মেকং নদী কমিশনের মতো বাংলাদেশও একটি কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। মেকং নদীর পানি কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনাম সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করে নিচ্ছে, যা তিস্তা সংকটের একটি মডেল হতে পারে।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী জানিয়েছেন, ‘একটা তিস্তা মানে এক টুকরো বাংলাদেশ। তিস্তা যদি শুকায়, বাংলাদেশ শুকায়। নদীর মৃত্যু মানে শুধু পানি হারানো নয়, তা হলো একটি জাতির প্রাণচক্রে আঘাত। বিশ্ব মরুকরণ প্রতিরোধ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক এর প্রতিরোধ।’ তিস্তার এই সংকট শুধু একটি নদীর সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের লড়াই।