Image description
১৭ আইপিও বাতিল বিএসইসির

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ মাস পুঁজিবাজারে কোনো নতুন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন হয়নি। অনেক আশা নিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন কমিশন নিয়োগ করলেও সেই আশায় গুড়েবালি। আস্থার বদলে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থাই কুড়িয়েছে এ সময়টা ধরে। বাজারের লেনদেন তলানিতে নামা, বড় অঙ্কের সূচকের পতন ঘটা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার সময় কাটছে। এর মধ্যে নতুন করে কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসা যোগ করেছে হতাশার নতুন মাত্রা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজার হচ্ছে পুঁজি জোগানের একটি জায়গা। নতুন নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের তারল্য বাড়বে। বিভিন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্তি হওয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে পুঁজিবাজারকে আরও উচ্চতায় নেওয়াই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাজ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নতুন সরকার আসার পর কমিশনের নতুন নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাজারে নতুন করে পুঁজির জোগান বন্ধ রেখেছে। এক্ষেত্রে যারা যে পাবলিক ইস্যু রুলসের কথা বলছে সেটি অনেক কঠিন। এত কঠিন নিয়ম মেনে পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া অনেকটাই কষ্টসাধ্য। তাই এই আইন সহজ করে নতুন করে সংশোধন করা দরকার।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএসইসির দায়িত্ব গ্রহণ করে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত একটিও আইপিও অনুমোদন করা হয়নি। বরং এ সময়ে বাতিল করা হয়েছে ১৭টি কোম্পানির আইপিও আবেদন, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

বিএসইসি ও ইস্যু ম্যানেজার সূত্রগুলো বলছে, গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তারা যেভাবে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন, তা দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে ২০১৯-২০২৩ সময়ে অনেক কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে বড় অঙ্কের পুঁজি সংগ্রহ করে। কিন্তু ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ২০২৪ সালের মাঝামাঝি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রবাহ একেবারেই থেমে যায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পুঁজিবাজার থেকে এক টাকাও সংগ্রহ করতে পারেনি কোনো কোম্পানি।

আইপিও না এলে কী হয়: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন পরিচালক কালবেলাকে বলেন, বিনিয়োগের বিকল্প সুযোগ না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারে তারল্য সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বাজারে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে, সেগুলোর ওপরই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ আইপিও রুলস ও দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া, দীর্ঘ সময় অনিয়মের মাধ্যমে বাজে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, সহজ ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান ও বর্তমান কমিশনের ওপর আস্থা না থাকায় আইপিও আবেদন আসছে না।

তিনি বলেন, আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির সুযোগ পায়। এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে, নতুন বিনিয়োগ প্রবাহিত হয় এবং কোম্পানিগুলোর মূলধন সংগ্রহ সহজ হয়। ফলে অর্থনীতিতে গতি আসে, কর্মসংস্থান বাড়ে এবং পুঁজিবাজারের গভীরতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।

শেষ কবে নতুন আইপিও এসেছিল: বিএসইসির সূত্র অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে সবশেষ এক বছর আগে আইপিও অনুমোদন দিয়েছিল বিএসইসি। ২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ও টেকনো ড্রাগস। চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এরপর আর কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হয়নি।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গত বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আর কোনো আইপিও অনুমোদন দেননি। আর ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিএসইসির দায়িত্ব নেওয়া খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশনও গত ১০ মাসে কোনো আইপিও অনুমোদন করেনি।

গত পাঁচ বছরের চিত্র: বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও।

তথ্যমতে, গত ১৬ বছরের মধ্যে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে কম আইপিও এসেছে। ২০২৪ সালে চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে। ২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, শিকদার ইনস্যুরেন্স ও ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। চারটি প্রতিষ্ঠান ২০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তার আগে ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ, ২০২১ সালে ১৫টি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৮৫৮ কোটি ৪৪ লাখ এবং ২০২০ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠান ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা উত্তোলন করে।

আইপিও আবেদনে সবসময় ব্যাপক আগ্রহ দেখান দেশের বিনিয়োগকারীরা। তথ্যমতে, টেকনো ড্রাগসের আইপিওতে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেকর্ড আবেদন জমা পড়ে, যা কোম্পানিটির শেয়ার বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি। এর আগে বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিওতে ৩৫০ কোটি টাকার শেয়ারের বিপরীতে ১ হাজার ৩২১ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি আবেদন পড়ে। অর্থাৎ একটি শেয়ারের বিপরীতে ৩ দশমিক ৭৭ গুণ আবেদন পড়ে।

নতুন আইপিও না থাকার ব্যাপারে যা বলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা: বিএসইসি ও ইস্যু ম্যানেজার সূত্র অনুযায়ী, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি যে ১৭টি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছে তার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে বলছেন সংস্থাটির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম। তিনি কালবেলাকে বলেন, কমিশন কাজ করে আইনের ভিত্তিতে। যেসব কোম্পানির আইপিও বাতিল করা হয়েছে, সেসব কোম্পানি পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ মানেনি। আইপিও আনা না আনা এটা ইস্যুয়ার কোম্পানির এখতিয়ার। তবে পাবলিক ইস্যু রুলসটা একটু কঠিন। আমরা টাস্কফোর্স করে রুলসটা সংশোধনে যাচ্ছি। এটি হলে কোম্পানিগুলো ভালো প্রাইস নিয়ে বাজারে আসতে পারবে।

মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে নতুন কোম্পানি বাজারে না আসা এটা পুঁজিবাজারের জন্য খুবই খারাপ। আইপিও হচ্ছে বাজারের প্রাইমারি কাজ। এটা যদি বন্ধ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে বাজার ভালোভাবে ফাংশন করছে না। এ ছাড়া পাবলিক ইস্যু রুলস অনেক কঠোর। আমরা অংশীজনের পক্ষ থেকে পাবলিক ইস্যু রুলস কেমন হওয়া হওয়া উচিত, তা বিএসইসিকে জানিয়েছি। এখন যদি বিএসইসি সেটাকে ধরে গেজেট আকারে প্রকাশ করে, তাহলে বাজারের জন্য ইতিবাচক হবে।

তিনি বলেন, আগে বিএসইসি জোরজবরদস্তি করে কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু আমরা চাই অনুমোদনের কাজটা করবে ডিএসই। আর এখানে সমন্বয় করবে বিএসইসি। আমরা একটি কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অপেক্ষা করার সময়সীমা দিয়েছি সর্বোচ্চ ছয় মাস। এ সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারবে। অনেক সময় ইস্যু ম্যানেজার এবং নিরীক্ষক কোম্পানি মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোম্পানি তালিকাভুক্তি করে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে নিরীক্ষক এবং ইস্যুয়ার কোম্পানি ধরা পড়লে এগুলোর ব্যাপারে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।