
ইরান ও দখলদার ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দামে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। মাত্র ৪ দিনে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের নিট দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের মতো। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারের তথ্য বলছে, মার্কিন তেলের দাম সর্বশেষ ১.২ শতাংশ বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৭৩.৮৫ ডলার হয়েছে। বৈশ্বিক মানদণ্ড ব্রেন্টের দাম ১ শতাংশ বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৭৫ ডলার হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দুই মাস পরে টের পাওয়া যাবে। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আমদানিনির্ভর দেশের জ্বালানি খাত হুমকিতে পড়তে পারে। কারণ বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের ২৬ শতাংশ সরবরাহ করে মধ্যপ্রাচ্য। প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় জোগান দেয় অঞ্চলটি। তাই ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম বাড়ার পাশাপাশি সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজগুলো রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বোঝাই করে এতদিন হরমুজ প্রণালি দিয়ে চলাচল করলেও এখন বাধার মুখে পড়ছে। বাধার মুখোমুখি বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের জাহাজগুলোও। ফলে জ্বালানি-গ্যাসের দাম বাড়ার আশঙ্কা অমুলক নয়।
গত সোমবার ইসরাইলের উপকূলীয় শহর হাইফায় বিস্ফোরণ দেখা গেছে। হামলার ভিডিওতে দেখা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো হাইফার একটি তেল শোধনাগারের আশপাশের এলাকায় আঘাত হেনেছে। সংঘাত এই অঞ্চল থেকে তেল রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা বাড়িয়েছে। ফলে বিশ্বের তেল সরবরাহের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ, হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেলের প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১২ই জুন রাতে ইরানে হামলা চালায় ইসরাইল। তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে হামলার পরদিনই বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম বাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। সেদিন ব্রেন্টক্রুডের প্রতি ব্যারেল ৬৮ থেকে বেড়ে ছাড়ায় সাড়ে ৭৬ ডলার। দিনশেষে দর ৭২ ডলারের নিচে নামলেও ১৪ই জুন আবারো ৭৪ ডলারে পৌঁছায়। সোমবার বিকাল পর্যন্ত দাম কমে দাঁড়ায় সাড়ে ৭২ ডলারে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট তেলের দামও এ সময় ওঠা-নামা করে। যুদ্ধ শুরুর আগের চেয়ে এখন ব্যারেলপ্রতি দাম বেড়েছে ৪ ডলার।
এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার সকালে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৬৪ সেন্ট বা ০.৮৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৮৭ ডলারে। অন্যদিকে, মার্কিন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দাম ৭৬ সেন্ট বা ১.০৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৩.৭৪ ডলার। এমনকি দিনের শুরুতে প্রতি ব্যারেলে দাম ৪ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। এর আগে শুক্রবার উভয় সূচকেই ৭ শতাংশ দাম বেড়ে জানুয়ারির পর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। বাস্তবতা হলো, ২০২২ সালের মার্চ মাসের পর গত শুক্রবার একদিনে তেলের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, এরমধ্যে তেলের দাম একদিনে আর কখনোই এতটা বাড়েনি। এ ছাড়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাতে হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কারণ এই নৌপথ দিয়েই বিশ্ববাজারে সরবরাহ হয় দৈনিক প্রায় ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল, যা বিশ্বের মোট ব্যবহারের এক-পঞ্চমাংশ। এই পথের ওপর নির্ভরশীল এশিয়া, ইউরোপ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও।
ফুজিটোমি সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক তোশিতাকা তাজাওয়া বলেন, ইসরাইলের হামলার কারণে ইরানের তেল উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। তবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে প্রভাব পড়বে আগস্টে: বাংলাদেশ দুবাই, সৌদি আরব থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এসব তেলবাহী কার্গো বাংলাদেশের পথে যাত্রার ১ থেকে ২ মাস আগের গড়মূল্য বিবেচিত হয়। তবে, পরিশোধিত তেল আমদানি হয় কার্গোলোডের সময়ের আন্তর্জাতিক বাজারদরে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রায় প্রতি দুই-চারদিন পরপরই জাহাজ আসতে থাকে। এটা তো প্রতিদিনের আন্তর্জাতিক বাজার দরে যাবে যেটা আমরা অনুসরণ করি। এই মাসে বাংলাদেশে যতগুলো পার্সেল আসবে সেগুলোর দাম অবশ্যই বাড়বে। এটার প্রভাবটা পরের মাসে পড়বে।
আইইইএফএ-এর প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল ইসলাম বলেন, যদিও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে, সেখানেও কিন্তু যে দাম আছে সে ব্রেন্টক্রুড তেলের দামের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার মানে এলএনজি’র দামের ওপর দামের সেই প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে যে ২৫/২৬ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে থাকি সেটার ওপর এর প্রভাব পড়বে। এর ফলে জ্বালানির এই বাড়তি দাম হয় জনগণের ওপর দিতে হবে অথবা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে।
দেশে মাত্র দেড় মাসের তরল জ্বালানি মজুত সক্ষমতা আছে। এ ছাড়া এলএনজি মজুতের কোনো সক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি এখনো। জাতীয় গ্রিডে আমদানিনির্ভর তরল এ গ্যাসের অবদান প্রায় ৩৫ শতাংশ।
গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালিপথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ইসরাইল ও ইরানের যুদ্ধ আমাদের জন্যে নতুন চ্যালেঞ্জ। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব সবার ওপর পড়বে। পোশাক শিল্পও এর প্রভাব থেকে বাদ যাবে না। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের অনেকগুলো কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি সকলের সহযোগিতায় এই কাজগুলো করতে আমরা সক্ষম হবো।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তা পুরো সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য হবে অশনিসংকেত। পণ্য পরিবহন খরচ অনেক গুণ বেড়ে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার হলেও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রপ্তানি বাড়ছে।