Image description

অন্তর্বর্তী সরকার অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়াটি মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলবে। অধ্যাদেশটির ভাষা অস্পষ্ট; এতে সরকারকে ক্ষমতায়িত করা হয়েছে; যা রাজনৈতিক সরকার ও ক্ষমতাসীনদের অপব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের অধ্যাদেশ হতাশাজনক। আরও আলোচনার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আজ শনিবার রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ভয়েস ফর রিফর্ম নামের নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ: রাষ্ট্রীয় নিবর্তনব্যবস্থা বহাল ও গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি অবজ্ঞা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলা হয়।

আলোচনায় জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠির সঙ্গে এই অধ্যাদেশের খসড়াটি মিলিয়ে দেখা যায়, একটু অদলবদল করে সেটা এই সরকারকে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক আইনে সবার ওপরে থাকে মানবাধিকার। আগের সরকার এবং এই সরকারও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করছে না, তারা নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এ দুটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক।

আগের সরকারকে লেখা চিঠিতে তিনি যেসব সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটা এবারও প্রযোজ্য উল্লেখ করে আইরিন খান বলেন, এখানে ভাষা অস্পষ্ট। এতে ঝুঁকি থাকে। অস্পষ্ট ভাষা যেখানে থাকে, সেখানে সরকারের ক্ষমতাসীনেরা এর অপব্যবহার করে। ভাষাকে শক্ত করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ২৫ ও ২৬ দুটি ধারাতেই সমস্যা রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা ও এই অধ্যাদেশ পাশাপাশি রেখে দেখা যাচ্ছে, সরকারের হাতে একই রকমভাবে ক্ষমতা রয়েছে।

আইরিন খান আরও বলেন, অপতথ্য ও ভুল তথ্যের বিষয়গুলো এই অধ্যাদেশে আসেনি। এগুলো আসা উচিত। এ ছাড়া মানহানি কেন ফৌজদারি আইনে থাকবে, সে প্রশ্নও তুলে বলেন, এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অনেক হুমকিতে পড়বে।

অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাইবার আইনটি নিয়ে কাজ করায় সরকারকে সাধুবাদ জানান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। তিনি বলেন, আইনটি প্রয়োজন। কিন্তু এই আইনের যে বিষয়গুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে, তার প্রক্রিয়া ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে শুরু হয়েছে আইসিটি আইনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সরকার তা রেখে দেয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারও তা রেখে দেবে, সে আশা ছিল না। তাঁর প্রশ্ন, রাজনৈতিক সরকারের সময়ে যেসব হয়রানিমূলক আইন হয়েছে, সেটা কেন আবার থাকবে।

সারা হোসেন বলেন, অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে সব পক্ষের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হলো কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। কাদের সঙ্গে আলোচনা হলো, কারা কী সুপারিশ দিল, সেটা সবাইকে জানানো উচিত।

ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-আহ্বায়ক এবং আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম বলেন, আইন প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছভাবে আলোচনা জরুরি। জনগণের স্বার্থে যদি আইন করা হয়, তবে জনস্বার্থকে আমলে নিতে হবে। এই সরকারের কাছে সবাই ভিন্ন কিছু চায়। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এই জায়গায় এসেছে সবাই। কিন্তু যা কিছু বলা হবে তা হজম করা হবে, সেটা যেন ভাবা না হয়।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, নিরাপত্তা আইনের কাঠামোর ওপরই সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশটি হয়েছে। এখানে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আছে। কিন্তু আগের মতোই সাধারণ নাগরিক, বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি বিশেষ করে সাংবাদিকদের একধরনের উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। অধ্যাদেশের সংজ্ঞাগুলো অগোছালো এবং সাইবার বুলিংয়ের ব্যাখ্যা নেই; বরং নানা শব্দের মধ্য দিয়ে মানহানিকে রাখা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের চিন্তা থেকে অধ্যাদেশটি হয়েছে। তিনি সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

এই আইনজীবী আরও বলেন, ধারা ২৫ অনুযায়ী, শৈল্পিক ও শিক্ষাগত মূল্য থাকলে কি তা অপরাধ হবে না? এ ছাড়া বলেন, ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাখ্যা নেই। এই ধারা আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে ছিল। এই ধারা কোনো সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে কাজে আসেনি; বরং তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, শেখ হাসিনার শাসনকালে খসড়ার কোন ভার্সনটা (সংস্করণ) আইন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে থাকতে হতো। এবারও খসড়াটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তিনি আশা করেন, সরকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই আইন করতে যাচ্ছে। সবার পরামর্শ নিয়ে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হবে।

অধ্যাদেশে নারী ও শিশুদের বিষয়ে আলাদা করে উল্লেখ আছে জানিয়ে টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ দিয়া বলেন, কিন্তু নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে। নারী ও শিশুদের অজুহাত দিয়ে মতপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। অধ্যাদেশটি এখন যেভাবে আছে, সেভাবে রাজনৈতিক সরকারের হাতে গেলে আইনের অপব্যবহার হবে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভূঁইয়া বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বলেছিল, স্পিচ অফেন্সের মামলাগুলো বাতিল হবে। কিন্তু সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বড় বড় দলের বড় বড় নেতাদের মামলা প্রশ্নাতীতভাবে বাতিল হলো, তাঁরা খালাস পেলেন। কিন্তু ডিজিটাল, সাইবার নিরাপত্তা, আইসিটি আইনের ভুক্তভোগীরা কি তাঁদের চেয়ে বেশি অপরাধী?

ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-আহ্বায়ক ফাহিম মাশরুর বলেন, আমলাতান্ত্রিক হাত দিয়ে খসড়া হলে অধ্যাদেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাবে না।

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, সাংবাদিক ও ই-আরকি সম্পাদক সিমু নাসের, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ প্রমুখ।