
ঝিনাইদহে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে আওয়ামী ক্র্যাকডাউনে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন চাকরিচ্যুত পুলিশ সুপার (এসপি) আলতাফ হোসেন। ফ্যাসিবাদের আজ্ঞাবহ পুলিশ সুপার হিসেবে ঝিনাইদহে দায়িত্ব পালনকালে তিনি অন্তত দেড় ডজন বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে ঝিনাইদহে পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা আলতাফ হোসেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। জেলার অনেক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী সে সময় জীবন বাঁচাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তুলে দিয়েছেন পুলিশের হাতে।
এসব ঘটনায় সাবেক এই কর্মকর্তাসহ অভিযুক্ত অন্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। তবে এসবের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। গত ১০ মাসেও আটক হয়নি হত্যা মামলার কোনো আসামি।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়ে ঝিনাইদহে ক্র্যাকডাউন শুরু করে। বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সাংগঠনিক দক্ষতা আছে এমন নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর আলতাফ হোসেন আটটি হত্যা মামলায় সরাসরি প্রধান আসামি হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ঝিনাইদহে একের পর এক হত্যা মামলা দায়ের হয়। চাকরিচ্যুত ও বর্তমানে পলাতক এসপি আলতাফের সঙ্গে আসামি হয়েছেন জেলা পুলিশের আরো ৪৩ সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল।
এজাহারে এক ব্যক্তি একাধিক হত্যা মামলারও আসামি হয়েছেন। পুলিশের পাশাপাশি এসব হত্যা মামলায় ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫৯ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের পরে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের হত্যার ঘটনায় আটটি হত্যা ও তিনটি ভাঙচুরের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াত কর্মী আব্দুস সালাম হত্যা মামলায় এক পুলিশ সদস্যসহ ৭০ জন, যুবদল নেতা মিরাজুল ও শিবির নেতা ইবনুল পারভেজ হত্যা মামলায় ১১ পুলিশসহ ২৮ জন, জামায়াত নেতা ইদ্রিস আলী পান্না হত্যা মামলায় ৬ পুলিশসহ ২৯ জন, শিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুন হত্যা মামলায় ৯ পুলিশসহ ১৪ জন, জামায়াত নেতা এনামুল হত্যা মামলায় ৫ পুলিশসহ ১৯ জন, জামায়াত নেতা ও ইউপি সদস্য হাফেজ আবুল কালাম আজাদ হত্যা মামলায় ৩ পুলিশসহ ১৯ জন, শিবির নেতা আবুজর গিফারী ও শামিম হত্যা মামলায় ৮ পুলিশসহ ২৩ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
চোরাচালানের স্বর্ণ আত্মসাতের ঘটনায় হন চাকরিচ্যুত
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলতাফ হোসেন ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ঝিনাইদহ থেকে সাতক্ষীরায় বদলি হন। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ সুপার হিসেবে সাতক্ষীরায় দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে জব্দ হওয়া চোরাচালানি স্বর্ণ আত্মসাতের বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে বিপ্লব চ্যাটার্জি নামের এক ব্যক্তি স্বর্ণের বড় একটি চালান ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা অভিমুখে বাসে আসছিলেন। ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু থানার এএসআই আব্দুর রউফ পল্টু ও কনস্টেবল মারুফ তাকে আটক করে। এক পর্যায়ে বিপ্লবের কাছ থেকে ওই স্বর্ণ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে বাজারের লোকজন পুলিশের ওই দুই সদস্যকে গণপিটুনি দিয়ে স্বর্ণসহ তিন জনকে পাটকেলঘাটা থানায় সোপর্দ করে।
পরে বিপ্লবের কাছ থেকে ১২০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা তৎকালীন ওসি মহিবুল ইসলাম এসপি আলতাফ হোসেনকে অবহিত করেন। আলতাফ পাটকেলঘাটা থানায় গিয়ে বিপ্লবের থেকে জব্দ করা স্বর্ণ নিজের কাছে নিয়ে নেন এবং পুলিশের দুই সদস্যকে ছেড়ে দিয়ে বিপ্লব চ্যাটার্জিকে একদিন পর ২১১ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়ার নির্দেশ দেন।
পরে একাধিক দপ্তরের তদন্তে স্বর্ণ আত্মসাতের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০২২ সালের ১৮ মে আলতাফ হোসেন চাকরি হারান।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঝিনাইদহের বর্তমান পুলিশ সুপার মো. মনজুর মোর্শেদ বলেন, মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। যেহেতু মামলাগুলোর ঘটনা অনেক আগের, সে কারণে এগুলো তদন্ত করতে আরো সময় লাগবে। আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা হলেই আটক হবে বা আটক করা যাবে বিষয়টি এ রকম না। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তবে তাকে আটক করা যাবে।