Image description

ফ্যাসিবাদের প্রোপাগান্ডা সেলের অন্যতম সদস্য সৈয়দ বোরহান কবিরের স্ত্রী অদিতি করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করাকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট।

শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া বিচারক আশরাফুল কামাল ও কাজী ওয়ালিউল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দিয়েছে। তাদের আদালতে অদিতির পক্ষে ওকালতি করেছেন সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সতর্ক অবস্থানের ফলে অদিতির ব্যাংক হিসাব জব্দ আছে এখনো।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে লিভ টু আপিলের অনুমতি চাওয়া হয়। এতে শুনানি শেষে চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্ট বিভাগের রায়কে স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়।

যদিও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আমার দেশ-এর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এমন মামলা আমি করছি বলে মনে পড়ছে না। অনেকেই মামলা করেন, পরবর্তী সময়ে আমার নামে চালিয়ে দেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আমার দেশকে জানান, এ মামলায় আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ছিলেন এবং তিনি অনেক উত্তেজিত হয়েছিলেন। চেম্বার জজ আদালতে এ মামলা নিয়ে দুই পক্ষের অনেক যুক্তিতর্ক হয়েছিল। এক পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছিলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল আসলেই স্টে দেওয়া হয়।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অদিতি করিমের ব্যাংক হিসাব খোলার সময় পেশায় লেখা রয়েছে গৃহিণী। কিন্তু তার ব্যাংক হিসাবে আছে ৯ কোটি টাকা। একজন গৃহিণী কীভাবে ৯ কোটি টাকা আয় করেনÑ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের সামনে এমন যুক্তি পাত্তা পায়নি। সব যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে অদিতির ব্যাংক হিসাব জব্দের নোটিসকে অবৈধ ঘোষণা করে দেন ফ্যাসিবাদের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারক।

প্রশ্ন উঠেছে, সৈয়দ বোরহান কবিরের স্ত্রীর হাতে এমন কী জাদুর কাঠি রয়েছে যে, গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার অ্যাকাউন্টে ৯ কোটি টাকার লেনদেনকে বৈধ মনে করতে পারে হাইকোর্ট? ব্যাংক হিসাব জব্দের নোটিস জারির দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্ট এটাকে অবৈধ ঘোষণা করে। মামলাটি এত দ্রুততার সঙ্গে রুল ইস্যু করে এক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার পেছনে রহস্য কীÑ এ নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয় আইনজীবীদের মধ্যেও।

আইনজীবীদের এমন কৌতূহলের সূত্র ধরেই অনুসন্ধানে পাওয়া যায় অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য, যা হাইকোর্ট পর্যন্ত সৈয়দ বোরহান কবিরের স্ত্রীর সাফল্য আলাদিনের চেরাগকেও হার মানায়। হাজারো মামলার জটে থাকা হাইকোর্ট বিভাগে অতিদ্রুততার সঙ্গে তার মামলার রুল জারি ও শুনানি নিষ্পত্তি হয়।

এটা হাইকোর্ট বিভাগে সচরাচর দেখা যায় না। বরং মামলার তদবিরকারীর জুতার তলা ক্ষয়ে যায় দরজায় দরজায় ঘুরতে ঘুরতে। তারপরও মামলা তালিকায় আসে না। আবার তালিকায় এলেও শুনানির জন্য ওঠে না। কিন্তু অদিতি করিমের মামলা রুলের জবাব দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার দিনেই চূড়ান্ত শুনানির তালিকায় চলে আসে। শুনানির জন্য নির্ধারিত তারিখেই মামলার নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি ক্যারিশমেটিক সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নেন সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন।

ঘটনাটির অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১৪ ডিসেম্বর ব্র্যাক ব্যাংক গুলশানের একটি ব্রাঞ্চ থেকে এক চিঠিতে গ্রাহক অদিতি করিমকে জানানো হয় ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তার অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত কোনো লেনদেন করা সম্ভব হবে না।

এই চিঠির বরাতে ব্যাংক হিসাব জব্দের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন অদিতি করিম। নথি অনুযায়ী গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দায়ের করা রিট পিটিশন নম্বর হচ্ছে ২২৮১/২০২৫। পরদিনই রিট আবেদনটি আশরাফুল কামাল ও কাজী ওয়ালিউল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে। ১৮ ফেব্রুয়ারি এই বেঞ্চ কারণ দর্শানোর রুল জারি করে। অদিতি করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি কেন অবৈধ ও বেআইনি হবে নাÑ এ মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও ব্র্যাক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কারণ দর্শাতে বলা হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, হাইকোর্ট বিভাগের জারি করা অনেক রুল বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় পড়ে আছে। অথচ এই রুলের ওপর শুনানির জন্য মামলা তালিকায় চলে আসে ১০ মার্চ। অর্থাৎ, ১৮ ফেব্রুয়ারি রুল ইস্যু করা হয়েছে। বিচারকদ্বয়ের বেঞ্চে শুনানির জন্য তালিকায় আসে ২২ দিনের মাথায়। ১৬ মার্চ শুনানির জন্য নির্ধারণ করে এবং সে দিনই আংশিক শুনানি হয়। ১৭ মার্চ শুনানি শেষ করে রায় দেওয়া হয়। রায়ে ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করেন বিচারক।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আমার দেশকে জানান, ‘তার দপ্তরের নজরে এলেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। হাইকোর্ট বিভাগে তার দপ্তরের নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যথাযথ যুক্তি দিয়ে আপত্তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু রায় হয়ে যাওয়ার পর দ্রুত আপিলের ব্যবস্থা করেন। আসাদুজ্জামান আরো বলেন, চেম্বার জজ আদালতেও ব্যারিস্টার মাহবুদ উদ্দিন খোকন অনেক তৎপর ছিলেন।

উল্লেখ্য, আশরাফুল কামাল ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত একজন সহায়ক। তিনি একটি মামলার রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সেনাপ্রধানের পদ ফিরে পাওয়া এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করাকে ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

ফ্যাসিবাদের পতন হলেও হাইকোর্ট বিভাগ আগের মতোই রয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদের নিয়োগ পাওয়া বিচারকরা আছেন বহালতবিয়তে। তাদের নিয়োগ দেওয়া দলীয় ক্যাডার, সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত এবং খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত এক নম্বর আসামি নিয়োগ পাওয়া বিচারক এখনো আছেন। তারা সুযোগমতো ফ্যাসিবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিচারকের আসনকে এখনো অপব্যবহার করছেন। সৈয়দ বোরহান কবিরের মতো একজন চিহ্নিত ফ্যাসিবাদের দোসরের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দই শুধু নয়, আরো অনেকের জামিনও মঞ্জুর করেছেন ইতোমধ্যে।