
লন্ডন বৈঠকের সাফল্যে শুধু রাজনৈতিক সংকটই কাটেনি, পুরো দেশ রাতারাতি নির্বাচনি ট্রেনে উঠে পড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। হাতে সময় এখনো ৭ মাস। তবু কারও যেন ফুরসত সইছে না। স্মরণকালের ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে নাম লেখাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। শুধু বিএনপি নয়, গণতন্ত্রকামী নির্বাচনমুখী সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থী অভূতপূর্ব এই নির্বাচনি উৎসবে যোগ দিতে মাঠে নেমে পড়েছেন। এছাড়া আসন ভাগাভাগিসহ পর্দার আড়ালে নির্বাচনি নানা হিসাব-নিকাশ ও সমঝোতার আলাপ সেরে নিতে অনেকে ছুটছেন সাজঘরে। লন্ডন বৈঠকের ফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুগান্তরের কাছে কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ ছিল এ রকম।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার প্রথম বৈঠকেই বাজিমাত। এক মুহূর্তে উবে গেছে সব অনিশ্চয়তা। অনেকের ভাষায়, একদিকে জনমনে বইছে স্বস্তির ঢেউ, বিপরীতে চরম হতাশায় নিমজ্জিত ষড়যন্ত্রকারীরা। কেউ কেউ বলছেন, ষড়যন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে লন্ডন বৈঠক।
এদিকে শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)-লন্ডনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের একথা জানানোর পর এখন সবার চোখ কমিশনের দিকে। ইসি সূত্র বলছে, আজ অনানুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কমিশন কার্যালয়ে বসার কথা রয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের। পরে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে কমিশন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতিতে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। আপাতত সেটা নিরসন হয়েছে। একটা বড় দলের সঙ্গে সরকারের একটা সমঝোতা হয়েছে একথা বলা যায়। ওই বৈঠককে ইতিবাচক বলছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। এভাবেই বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। সে কারণে নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে।
তবে তিনি এও বলেন, এখনো সব সংশয় কাটেনি। কারণ এর মধ্যে একটি শক্তি বলেছে, একটি দলকে খুশি করার জন্য এই বৈঠক হয়েছে। আশা করি সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক একটা টার্নিং পয়েন্ট করার জন্য বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সারা বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, বৈঠকের পরে তা সম্পূর্ণভাবে সংকট সমাধানের দিকে গেল। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়েই তো নানা রকমের প্রশ্ন উঠেছিল। দেশ এখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকে সংস্কার ও বিচারের কথা বলছে-কিন্তু এটা নির্বাচনকে কোনো রকমের বাধাগ্রস্ত করবে না।
বিএনপিসহ অন্তত দশটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ সম্ভাব্য প্রার্থী নিজ এলাকায় গিয়েছিলেন। কেউ কেউ এখনো এলাকায় আছেন। লন্ডন বৈঠকের পর ‘রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে’-এমন বক্তব্যে প্রার্থীরা এলাকায় যোগাযোগ আরও বাড়িয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, সব সময়ই বিপদে-আপদে এলাকার মানুষের সঙ্গে থাকি। যেহেতু নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল, এখন তা আর নেই। স্বাভাবিকভাবেই এলাকায় মানুষ আসছে, আবার নিজেও এলাকায় আছি।
লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে। বহুল আকাক্সিক্ষত নির্বাচন। বলতে পারেন নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, মাসের পনেরো দিনই এলাকায় থাকি। এখন আরও বেশি থাকব, পুরো সময়টাই নির্বাচনের মাঠ গোছানোর কাজে সময়টা ব্যয় করব।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি মিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে রোজার পূর্বে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে বলে দলের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। লন্ডন বৈঠকেও একই মাসে নির্বাচন করার বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ায় এ নিয়ে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। তবে দলটি মনে করে, সরকারপ্রধান হিসাবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। তবে জামায়াত সূত্র জানায়, তারা ইতোমধ্যে ২৯৬ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরেই নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় কাজ করছেন।
প্রশংসায় ভাসছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান : লন্ডন বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব নোবেল জয়ী ড. ইউনূসকে যথাযথভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তারেক রহমান। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখায় এজন্য তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন। ইতিবাচক দিক তুলে ধরে অনেকে তারেক রহমানকে নিয়ে নানা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
দেশে ফিরছেন তারেক রহমান : বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দ্রুতই বিএনপির এই শীর্ষ নেতা দেশে ফিরছেন। ৫ আগস্টের আগেই তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারেন। অথবা নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পরপরই দেশে ফিরবেন। নির্বাচনি ডামাডোলের এক উত্তাল সময়ে তিনি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসবেন। সেদিন তাকে স্বাগত জানাতে অন্তত ১০ লাখ লোক সমবেত হবে ঢাকায়। সারা দেশ থেকে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ধরে রাখাই কঠিন কবে। রাজধানী ঢাকা এক জনারণ্যে পরিণত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক এক মহানায়কের আগমনে উপচে পড়া সে ঢেউ সারা দেশে নির্বাচনি জোয়ারে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করবে অনায়াসে।
শত্রুপক্ষের চরম পরাজয় : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, লন্ডন বৈঠক সফল হওয়ায় গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী সব অপশক্তি শত্রুদের চরম পরাজয় হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথ ইস্যু এবং কাক্সিক্ষত সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সরকার তথা ড. ইউনূসের মধ্যে যে বৈরী অবস্থা তৈরি হয়েছিল সেটি এখন আর নেই। এক বৈঠকেই সব উত্তাপ উবে গেছে।
সরকার গঠন করতে পারলে ড. ইউনূসকে পাশে চায় বিএনপি : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ আছে। বিএনপিকে জনগণ যদি ভোট দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আনে, তাহলে অবশ্যই দেশের জন্য ড. ইউনূসকে কাজে লাগানো হবে। দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এ ব্যাপারে তার পরামর্শ নেওয়া হবে। এরকম আরও যারা আছেন তাদের মতামত নিয়ে কাজ করতে চান তারেক রহমান। লন্ডন বৈঠকে এ প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আগামীতেও আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহযোগিতা চাই, যা উনাকে জানানো হয়েছে। জনগণ যদি বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব দেয়, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চর্চার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে পাশে পাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা হাসিমুখে এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন কিনা জানি না, তবে তিনি মনে হয় এর গুরুত্ব অনুধাবন করবেন।’
বাড়ছে কূটনীতিক তৎপরতা : অন্যদিকে বিদেশিদের তৎপরতাও বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে তারা এ প্রসঙ্গে কথা বলছেন, নিজেদের মতামত তুলে ধরছেন। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক তথা গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জানাচ্ছেন তাদের দেশের আগ্রহের কথা। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকও করছেন। প্রতিটি বৈঠকেই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বোঝার চেষ্টা করছেন-আগামী নির্বাচন কেমন হতে পারে, কোন দলের কৌশল কী হবে। রাজনৈতিক দলগুলোরও চলছে নানা তৎপরতা। ১৭ জুন ঢাকায় মার্কিন একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে। এছাড়া ২৪ অথবা ২৫ জুন চীন সফরে যাচ্ছে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে রয়েছেন-দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরউদ্দিন স্বপন, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়াসহ নয়জন। চীনা সরকারসহ কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে এই সফর, এমনটি বলছে বিএনপি। এরপর জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দলের প্রতিনিধিদলের চীন যাওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ যুগান্তরকে বলেন, তারা আমন্ত্রণ পেয়েছেন, এখনো তারিখ চূড়ান্ত হয়নি।