
দেশের বেসরকারি খাতের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল ছিল সিনেমার গল্পের মতো। ব্যাংক ডাকাত এস আলম ব্যাংক দু’টি দখলে নিয়েছিল ২০১৭ সালে। কিন্তু দুই বছর আগেই দখলের যাবতীয় ছক আঁকা হয়েছিল। আর এজন্য চতুর এস আলম বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক দু’টির কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ব্যাংক দখলের কাজে ব্যবহার করেন। ইসলামী ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল এস আলমকে। আর ওই ঋণের অর্থ দিয়েই ব্যাংকটির শেয়ার কেনা হয়। এভাবে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় নিয়ে নেন এস আলম। গভীর রাত পর্যন্ত ব্যাংক দখলের কাগজপত্র ঠিক করে দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ব্যাংক দু’টি কিভাবে দখলে নেয়া হয়, কিভাবে শেয়ার হস্তান্তর করা হয় এবং কোনো তদন্ত করা হয়েছিল কি না তার যাবতীয় নোটশিটসহ নথি তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দুদক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ওই সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে এ বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের বরাদ দিয়ে সূত্রটি জানিয়েছে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংক থেকে এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ওই টাকা দিয়েই বেনামে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কিনেছিল চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম। নিয়ম লঙ্ঘন করে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সোনালী ট্রেডার্স, এস আলম রিফাইনড ভেজিটেবল অয়েল এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েল এই তিন কোম্পানির নামে এক হাজার ৭৫০ টাকা ঋণ বের করা হয় ইসলামী ব্যাংক থেকে। পরে অন্য তিনটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কেন এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং এর সহযোগী সোনালী ট্রেডার্সকে ইসলামী ব্যাংক ঋণ দেয় ৫০০ কোটি টাকা। সোনালী ট্রেডার্স থেকে অর্থ নিয়ে এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের নামে ঋণ দেয়া হয় ৮৫০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের নামে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এই টাকা দিয়ে ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেসের নামে ইসলামী ব্যাংকের ৪.৬৭ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালের মধ্যে আরমাডা স্পিনিং মিলস, জেএমসি বিল্ডার্স, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, গ্রান্ড বিজনেস লিমিটেড ও ব্লু ইন্টারন্যাশনালের নামেও বেনামি শেয়ার কেনা হয়। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির বিনিয়োগ ও আইন বিভাগের মতামত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। নেয়া হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। আমলে নেয়া হয়নি ব্যাংকটিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের পরামর্শ। একক গ্রাহকের সীমা লঙ্ঘিত হওয়ায় এই ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়া হয়। এমনকি একজন বিদেশী পরিচালককে ওই সভায় অনুপস্থিত রাখতে রাজধানীর একটি হোটেলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরও নামে-বেনামে ঋণের নামে লুটপাট অব্যাহত রাখে গ্রুপটি এবং লুটপাটের টাকায়ও বিভিন্ন সময় ব্যাংকটির শেয়ার কেনা হয়।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠিকভাবে ব্যাংকটি দখলের পর বেনামি এই শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই ব্যাংকটিতে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণপ্রস্তাবে স্পষ্টভাবে থাকতে হবে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে এবং সেই উদ্দেশ্যেই ঋণ ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে এখানে ঋণের অপব্যবহার হয়েছে। সূত্র মতে, এস আলম গ্রুপকে ব্যাংক লুটপাট ও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে সহায়তা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ও তিনজন ডেপুটি গভর্নর। আর এ কাজে সরাসরি ভূমিকা রাখেন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর সিতাংসু কুমার সুর ওরফে এসকে সুর। আর ব্যাংকটি আনুষ্ঠানিক দখলে নেয়ায় সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তারা।
একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকটিও দখল করে কুখ্যাত এস আলম। ব্যাংকটির এমডি ও চেয়ারম্যানকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দিয়ে তুলে নেয়া হয়। তারপর জোর করে তাদের কাছ থেকে শেয়ার ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বোর্ড নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
পরবর্তীতে ব্যাংক দু’টি থেকে টাকা লুট করে খালি করে ফেলা হয়। একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই পাঁচ বছরে ঋণের নামে এস আলম লুট করেছে এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে পানির মতো টাকা বের করে নেয়ায় ব্যাংকটি এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
দুদক থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক কিভাবে দখলে নেয়া হয়েছিল, শেয়ার কিভাবে হস্তান্তর করা হয়েছিল, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কোনো তদন্ত করা হয়েছে কিনা তার নোটশিটসহ যাবতীয় নথি আগামী ২৫ জুনের মধ্যে দুদকে পাঠাতে বলা হয়েছে।