
‘আমার অধিকার কি আমি নিতে পারমু না? মাইরা ফেলবে এই জন্য? গুম-খুন করে ফেলবে? ওরা তো ওই চেষ্টা করছেই।’ গুমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল ভয় ও নীরবতা। গুম থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া ব্যক্তিদের জীবনে ‘ভয়’ সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। এরা ট্রমাটাইজড হয়ে যান। এমনকি তাদের নিজস্ব বাড়িতেও নিরাপদবোধ মনে করেন না। এক ধরনের ভয় কাজ করে সব সময়। গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে গুম থেকে ফিরে আসা এক ব্যক্তির সাক্ষাতকার স্থান পেয়েছে।
ওই ব্যক্তি তার সাক্ষাতকারে বলেছেন, পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে আমি জেল থেকে যখন বাড়িতে গেছি, আমারে জোরে কথা বলতে দিত না। আমাদের মেইন রোডের পাশেই বাড়ি। অনেক সময় কথা বললে একটু বাড়ির বাইরে আওয়াজ চলে যায়। তাই জোরে কথা বলতে দিত না। কেন? আব্বার ভয় হলো যে, যদি আমার কোন কথার আওয়াজ বাইরে যায়! আব্বা কইতো যে, ‘একটা থেকে বাইচে আসছোস, এ পর্যন্তই থাক।’ আমি বলতাম যে, ‘আব্বা, আমারে কেউ মারবে, আমি কি একটু কানতেও পারমু না?’ কয় যে, ‘না, কাঁদার বহু সময় আছে, আল্লাহ কাঁদার সময় দিব। এখন তুই কানতেও পারবি না। তুই কান্দা ছাড়াই থাক।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আব্বার দেখাদেখি আমার ওয়াইফও আমার সাথে প্রায় সময়ই কঠোর আচরণ করতো। কোন একটা বিষয় আসলে যদি আমি বলতে চাইতাম যে: ‘ওরা আমাদের জমিগুলো অন্যায়ভাবে দখল করে রাখবে, আপনারা কোন কথা বলবেন না, এটা হইলো? আমার অধিকার কি আমি নিতে পারমু না? মাইরা ফেলবে এই জন্য? গুম-খুন করে ফেলবে? তো ওরা তো ওই চেষ্টা করছেই। এই জন্য কি আমি জমির পাশে যাইয়া দাঁড়াইতে পারমু না?’ তো আমার ওয়াইফ আমার ভাইয়েরে ফোন দিত যে, ‘আপনি ভাইরে বুঝান, উনি যাতে এগুলোর কথা না বলে। জমি যা হয় হবে। জমি তকদিরে থাকলে আসবে।’
গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে যুক্তরাজ্যের কনসালট্যান্ট ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট এবং রয়্যাল কলেজ অফ সাইকিয়াট্রিস্টের স্বেচ্ছাসেবক ও আন্তর্জাতিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আনিস আহমেদ বিশ্বব্যাপী ক্লিনিকাল অন্তর্দৃষ্টির উপর ভিত্তি করে, তিনি ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের এবং এখনও নিখোঁজদের পরিবারের উপর জটিল এবং প্রায়শই ভুল বোঝাবুঝি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাবের উপর জোর দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ফিরে আসা ভুক্তভোগীরা প্রায়শই কেবল পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার নয় বরং মেজর ডিপ্রেশনাল ডিসঅর্ডার, জেনারেলাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, জটিল ট্রমা এবং কিছু ক্ষেত্রে অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার এবং ডিসোসিয়েটিভ লক্ষণগুলিতেও ভোগেন। সাধারণ উপস্থাপনাগুলির মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা, মানসিক অসাড়তা, অ্যানহেডোনিয়া, বিরক্তি, হিংসাত্মক বিস্ফোরণ এবং হাইপারভিজিল্যান্স, যা অনুভূত বা বাস্তব হুমকির সাথে যুক্ত সতর্কতার একটি উচ্চতর অবস্থা। অনেকে জনসাধারণের মনোযোগের গভীর ভয়, নজরদারি, সামাজিক বিচার বা পুনর্নবীকরণ লক্ষ্যবস্তুর ভয়কেও বর্ণনা করেন।