
মো. সিরাজুল ইসলাম, যিনি বর্তমানে আছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে- এই পদে আবেদন করার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা কোনোটিই তার নেই। অথচ গত প্রায় ২১ বছর ধরে এই সিরাজুল ইসলাম সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনার প্রধান এ পদটি দখল করে আছেন।
২০০৪ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের মৃত্যুর সুবাদে ভাগ্য খুলে যায় সিরাজুল ইসলামের। প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের মৃত্যুর পর তখনকার কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত দায়িত্বে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদ বাগিয়ে নেন। ‘সাময়িক সময়’র কথা বলে তাকে এ পদের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি অতিরিক্ত দায়িত্বে এই পদে বহালই আছেন। সিরাজুল ইসলামের মূল পদ স্থপতি, যদিও এই পদে নিয়োগ পাওয়ারও যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা ছিল না তার। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’ হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ‘স্থপতি’ পদে নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছিলেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনকৃত তফসিল অনুসারে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদে ডেপুটেশন এবং পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ করা যাবে। প্রেষণে নিয়োগের বিষয়ে তফসিলে বলা হয়েছে, স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে। এবং সমমানের পদমর্যাদায় সরকারি/ আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে হবে। অন্যদিকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কমপক্ষে ৭ বছরের অভিজ্ঞতা এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। কিন্তু এর কোনোটিই সিরাজুল ইসলামের ছিল না বা নেই। তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৪ সালে এবং এইচএসসি ১৯৮৬ সালে। পরবর্তীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। পড়াশোনায় দীর্ঘ গ্যাপ তৈরি হয়। এক পর্যায়ে সেখানকার খরকভ ইনিস্টিটিউট অব মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স, ইউক্রেন হতে রাশিয়ান ভাষায় ৩০ জুন ১৯৯৪ ডিপ্লোমা অর্জন করেন। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেননি বা আর্ন্তজাতিক ভাষায়ও পড়েননি। ওই ডিপ্লোমা সার্টিফিকেটেই তিনি ১৯৯৭ সালে ‘স্থপতি’ পদে ঢাকা সিটি কর্পোরেশেনের চাকরিতে ঢোকেন, যদিও ‘স্থপতি’ পদে নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী এই সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য ছিল না।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত তফসিল এবং চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে ‘স্থপতি’ পদে নিয়োগের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয় তাতে বলা হয়েছে, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত হতে হবে। এবং কোনো সরকারি বা আধা সরকারি/ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নগর স্থাপত্য বিষয়ক কাজে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কিন্তু সিরাজুল ইসলামের এ ধরণের কোনো যোগ্যতাই ছিলো না। তিনি কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রিধারী নন। এমনকি সমমানের ডিগ্রিও তার নেই, যদিও সমমানের ডিগ্রির কথা চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কোনো সরকারি, আধা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নগর স্থাপত্য বিষয়ক কাজে কখনো নিযুক্তও ছিলেন না তিনি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন ১৯৯৪ সালে। আর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের স্থপতি পদে চাকরিতে ঢোকেন ১৯৯৭ সালে। অর্থাৎ ‘কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা’র শর্ত পূরণ করেননি সিরাজুল ইসলাম। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় তিনি কখনো সম্পৃক্ত ছিলেন না। ৫ বছর তো দূরের কথা, একদিনের জন্যও তিনি কোথাও ‘স্থাপত্য’ পদে কাজ করেননি। অর্থাৎ স্থপতি পদের ক্ষেত্রে তার কোনো অভিজ্ঞতাই ছিলো না। এরপরও সিরাজুল ইসলাম উক্ত পদে কীভাবে নিয়োগ পেলেন এবং কিভাবে এতোদিন যাবৎ কাজ করে আসছেন তা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে নানান প্রশ্ন রয়েছে।
মূল পদ ‘স্থপতি’ হিসেবেই যার নিয়োগের বৈধতা নেই, তিনিই আবার অতিরিক্ত দায়িত্বে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদ দখল করে রেখেছেন দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ধরে। যা মহা অবাক করার মতো ঘটনাই বটে! ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর সিরাজুল ইসলামকে যখন ‘স্থপতি’ পদের পাশাপাশি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয় তাতে বলা হয়েছিল, “ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদে জনবল নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত একই বিভাগের স্থপতি জনাব মো. সিরাজুল ইসলামকে তার নিজ দায়িত্বসহ সাময়িকভাবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এর অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হলো।” ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তখনকার সচিবের স্বাক্ষরে এ অফিস আদেশটি জারি করা হয়। কিন্তু সেই জনবল নিয়োগ এখন পর্যন্ত হয়নি। নিয়োগের উদ্যোগও নেয়া হয়নি। সিটি কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন মহলকে ম্যানেজ করে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদে জনবল নিয়োগের বিষয়টি ঠেকিয়ে রেখেছেন তিনি। এ পদে চাকরি করার কোনো যোগ্যতা তার না থাকলেও সবাইকে ম্যানেজ করার যোগ্যতা ঠিকই রপ্ত করেছেন সিরাজুল ইসলাম। বলা যায়, এ কাজে তিনি পাকাপোক্ত। সিটি কর্পোরেশনের নানা খাত থেকে অর্থ লুটপাট করে এনে এ বাবদ ব্যয় করছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোশেনকে দ্বিখণ্ডে বিভক্ত করে (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোশেন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোশেন)। কিন্তু দ্বিখণ্ডে বিভক্ত করার পর ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ পেলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কোনো প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদে অযোগ্য-দুর্নীতিগ্রস্ত সিরাজুল ইসলামই থেকে যান। শুধু তাই নয়, এই পদগুলোর পাশাপাশি তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকের পদও একই সঙ্গে দখল করেন ঊর্ধ্বতন মহলকে ম্যানেজ করে। এসব প্রকল্পে ব্যাপকহারে লুটপাট চালান। আর লুটপাটের সেইসব অর্থে শীর্ষ ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে পদে বহাল থাকার কৌশল অবলম্বন করেন।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য যথাযথ কাজে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রকৌশল, স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ এসবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে যথাযথ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সম্পন্ন লোক ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। এমনিতেই ডিএসসিসির বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অবস্থা খুবই নাজুক। উন্নয়নের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। তার ওপর এরকম অযোগ্য লোক সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে জোর করে বসে আছেন। এতে নগরের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।
উল্লেখ্য, দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে ইতিমধ্যে দুদক। দুদকের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনা তৈরির নামে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ট্রাফিক সিগনাল স্থাপনের ৩৮ কোটি টাকা আত্মসাতসহ অনেক অপকর্মের সঙ্গে সিরাজুল ইসলাম সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে।
শীর্ষনিউজ