
বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত ১৪ মে থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগরভবনে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করে আসছেন তার সমর্থকরা। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন করপোরেশনে কর্মরত কর্মচারীদের বড় একটি অংশ। ফলে বন্ধ রয়েছে প্রায় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। যার কারণে ভোগান্তির অন্ত নেই নগরভবনে আসা সেবাপ্রার্থীদের।
টানা ২০ দিন নগরভবনে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করার পর গতকাল মঙ্গলবার (৩ জুন) চলমান কর্মসূচিতে এসে ইশরাক হোসেন ঘোষণা দেন, ‘ঈদ উপলক্ষে জনভোগান্তির কথা বিবেচনা করে নগরভবন অবরোধ বা ঘেরাওয়ের যে কর্মসূচি সেটাকে কিছুটা শিথিল ও বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকার শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিলে ছুটির পর আরও কঠোর আন্দোলন করবে ঢাকাবাসী।’
ইশরাক হোসেনের এমন বক্তব্যের পর নগরবাসী এবং সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন, আজ নগরভবনে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলবে। কিন্তু বাস্তবে এখনও নগরভবনে তালা ঝুলছে। এমন পরিস্থিতিতে জনমনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, নগরভবনের তালা খুলবে কবে?
বুধবার (৪ জুন) দুপুরে সরেজমিন নগরভবনে গিয়ে দেখা যায়, কোনও কর্মসূচি নেই, তবু তালাবদ্ধ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগরভবন। করপোরেশনে কর্মরত বিএনপি সমর্থিত শ্রমিক কর্মচারীরা এখনও নগরভবনের তালা খোলেননি। ফলে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম।
নগরভবনের তালা কবে খোলা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনকারীরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইশরাকের শপথ গ্রহণ ছাড়া নগরভবনের তালা খোলা হবে না।’
ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)
আন্দোলনকারীদের একজন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের স্পষ্ট রায়ের পরও সরকার ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে টালবাহানা করছে। মেয়র ছাড়া জনভোগান্তি আসলে কেউ বুঝবে না। গত ২০ দিন ধরে নগরভবনে যে জনভোগান্তি চলছে তার একমাত্র দায় এই সরকারের।’
স্বেচ্ছাসেবক দলের এই নেতা আরও বলেন, ‘সরকার উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে। যা দৃষ্টিকটু। এরমধ্যে দিয়ে কিন্তু সরকার নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর আগ পর্যন্ত নগরভবন তালাবদ্ধ থাকবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘কোর্ট রায় দেওয়া সত্ত্বেও ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। উপদেষ্টার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তিনি শপথ নিতে পারছেন না। আজ সাধারণ জনগণের যেই ভোগান্তি, নাগরিকরা যে সেবা পাচ্ছে না, তার জন্য মূলত দায়ী উপদেষ্টা।’
নগরভবনের তালা খুলবে কবে? এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের এই নেতা বলেন, ‘ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণের মাধ্যমেই জনভোগান্তি কমবে এবং নগরভবনের তালা খুলবে।’
এদিকে নগরভবন তালাবদ্ধ থাকার কারণে গত ১৪ মে থেকে জন্ম মৃত্যুনিবন্ধন, ওয়ারিশান সনদ, নতুন ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসার অনুমতিপত্র), ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন, কর জমাসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। নগরভবনে এসে সেবা প্রার্থীদের প্রতিনিয়ত ফিরে যেতে হচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকেও এসব কাজ কীভাবে করা যাবে তার বিকল্প কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা।
পুরান ঢাকার বংশালের বাসিন্দা সুরাইয়া বেগম ছেলের জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে গত দুই সপ্তাহ ধরে নগরভবনে আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু চলমান আন্দোলনের কারণে সেই কাজটি করতে পারছেন না। বাংলা ট্রিবিউনকে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তারা আন্দোলন করছে করুক, কিন্তু সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কীসের আন্দোলন! আমার মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন নগরভবনে আসছেন আর ফিরে যাচ্ছেন। জানি না ঠিক কবে আমার কাজটা করতে পারবো, নাকি পারবো না।’
নগরভবনের সামনের ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলন কর্মসূচি (ফাইল ছবি)
ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী সাবেক সচিব মশিউর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত জরুরি সেবার কাজটি চলমান। এই বিভাগের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের মালামাল নিতে পারবেন। শহরে ময়লা আবর্জনার যেন কোনও স্তূপ না হয়, সাধারণ নাগরিকদের যেন কোনও ধরনের ভোগান্তি না পোহাতে হয়, তার জন্য এই সেবা চালু থাকবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মী ও করপোরেশনের কর্মচারীদের কর্মসূচির কারণে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে প্রায় সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। কবে নগরভবন খুলবে, কবে আবার নগরবাসী আগের মতো স্বাভাবিকভাবে নগরভবন কেন্দ্রিক সেবা পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমাদের কাছে এর সঠিক কোনও উত্তরও নেই।’
কর্মসূচি শিথিল হলেও নগরভবনে তালা ঝুলিয়ে রাখার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্মসূচি শিথিল হলেও তালা খোলা হয়নি। আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মচারীরা তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। যার কারণে নগরভবন কেন্দ্রিক সেবা বন্ধ। তবে নগরভবনের বাইরের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’
নাগরিক সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের সেবা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নগরভবনে কর্মরত সবার ছুটি স্থগিত করা হয়েছে। ঈদের পরে করপোরেশনের সবাই ছুটি পাবেন।’
নগরভবনে তালা খুলবে কবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বিষয়টি তো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।’
এদিকে আন্দোলন শিথিল করার পরেও ‘নগরভবন কেন এখনও তালাবদ্ধ’ তা জানতে একাধিকবার ইশরাক হোসেনকে মুঠোফোনে কল করলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন এই প্রতিবেদক।