Image description

প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সময় এলেই দেশের পশুর চামড়া নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। ঈদের সময় বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হলেও বছরের অন্য সময়গুলোতে চামড়াশিল্প পড়ে থাকে নানাবিধ সংকটে। একদিকে চামড়ার দাম পড়ে যায় অনেকটাই, অন্যদিকে মানসম্পন্ন প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বিপাকে পড়েন চামড়া ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা। পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতিও।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩৯৭ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (জুলাই থেকে এপ্রিল) নেমে এসেছে মাত্র ১০৭ মিলিয়নে। অর্থাৎ গত এক দশকে রপ্তানি কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। অথচ বিশ্ববাজারে চামড়াজাত পণ্যের মোট মূল্য প্রায় ৪২০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় সামান্য।

জানা যায়, এই সংকট নিরসনে ২০১৭ সালে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে দেশের প্রধান চামড়া প্রক্রিয়াজাত এলাকা সরিয়ে নেওয়া হয় সাভারে। উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান অর্জন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে খাতটিকে টেকসই করা। তবে বাস্তবতা হয়েছে উল্টো। অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না হওয়া, অর্থসংকট ও আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে চামড়াশিল্প ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে।

চামড়াশিল্প ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারে স্থানান্তরের পর ২২০টি ট্যানারি নতুন এলাকায় বসানো হলেও অনেক ট্যানারিই কার্যকরভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি। নগদ অর্থসংকট, পর্যাপ্ত অর্ডার না পাওয়া, সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতা এবং ব্যাংকঋণের দায়-সব মিলিয়ে এ খাত গভীর সংকটে রয়েছে। এ ছাড়া চামড়ার মান নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা। তারা জানান, ঈদের সময় কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক। অদক্ষ জবাই পদ্ধতি, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত সংরক্ষণের কারণে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। চামড়ার পুরুত্ব ও মান যাচাই হচ্ছে অনুমাননির্ভর পদ্ধতিতে, যা মানসম্পন্ন চামড়া বাছাইকে জটিল করে তুলছে। এর ফলে বিদেশি ক্রেতারা আস্থা হারাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য চামড়ার মূল্য অনেক কম পাচ্ছেন তারা। অনেক সময় বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের চামড়া কিনতেই চান না। আবার মানসম্পন্ন কাঁচামালের ঘাটতিতে বিদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে।

তারা জানান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ অর্থায়নের সুযোগ নেই। প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতিসহ আধুনিক মেশিন ও প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে পিছিয়ে পড়ছে সম্ভাবনাময় এ খাতটি। বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বাংলাদেশে মাত্র সাতটি ট্যানারি আন্তর্জাতিক এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত, যেখানে ভারতের রয়েছে ২৫৩টি, চীনের ২০০টি এবং পাকিস্তানে ৪৪টি ট্যানারি। এর ফলে বাংলাদেশের চামড়া বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, যদি একটি যথাযথ এলডব্লিউজি সিইটিপি সনদ না থাকে, তাহলে কোনো ট্যানারি নিরীক্ষায় আসবে না। আমরা টাকা-পয়সা খরচ করে বসে থাকব, তারপর আগামী ২০ বছর ধরে এই সিইটিপি ঠিক করবে, তাহলে আমাদের ওই ট্যানারিগুলো কি বাদ যাবে না মরবে? সিইটিপি ঠিক না করলে কোনো অডিট আসবে না। এটা ঠিক করার দায়িত্ব সরকারের। এ ছাড়া ন্যায্যমূল্যে চামড়ার দাম না পাওয়া আমাদের জন্য বড় সমস্যা। এটার কারণে চামড়া খাতে বড় ধস নেমেছে। যদি আমাদের কাছে এলডব্লিউজি সনদ থাকত তাহলে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারতাম আমরা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল আসেনি। আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। সিইটিপি এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পরিবেশবান্ধব উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। আবার এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় ক্রেতারা বাংলাদেশের চামড়া নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা রপ্তানির জন্য চীনা মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, যারা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কম দামে চামড়া কিনে থাকেন। এর ফলে প্রকৃত মূল্য থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এই পরিস্থিতি থেকে চামড়াশিল্পকে রক্ষায় সরকারের কাছে ট্যানারি মালিকদের সহজ শর্তে ঋণসহায়তা দেওয়া এবং এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।