Image description

একটি চাঁদাবাজির মামলা নিয়ে সিলেটে নানা জল্পনা। বিরোধ ভূমি সংক্রান্ত। মামলার হুমকিও এসেছিল। সেই হুমকির বিষয়টি বার বারই পুলিশকে অবগত করেছিলেন গোয়াইনঘাটের ধর্মগ্রামের সালেহ রেজা। পুলিশকে বলছিলেন; ‘দস্যার ওরা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিতে হাঁটছে।’ বিষয়টি আগেভাগে পুলিশকে জানিয়েছিলেন বিএনপি নেতারাও। কিন্তু সেই সালেহ রেজার বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ। মব সৃষ্টি করে রেজাকে মারধরের পর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে অবশ্য এলাকাবাসী ফুঁসে উঠলে ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ আলোচিত মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দাখিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সালেহ রেজা গোয়াইনঘাটের বারহাল বাজারের একজন ব্যবসায়ী। সমাজসেবকের পাশাপাশি তিনি শিক্ষানুরাগীও।

আলীরগাঁও কলেজের বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য। একই গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হাজী আব্দুস শুকুরের সঙ্গে গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব। ধর্মগ্রাম হাওরের একপাশে বিন্নাউরি। ভূমি পরিমাণ ১৩৫ বিঘা। যুগ যুগ ধরে গ্রামের মানুষের রেকর্ডীয় এ ভূমি গো-চারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগের ঘটনা। আব্দুস শুকুর গো-চারণ ভূমিতে তার নিজস্ব জায়গাসহ ক্রয়কৃত ২০-২৫ বিঘা ভূমিতে চাষাবাদ করতে যান। এতে প্রথমে বাধা দেন গ্রামের মানুষ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে; গো-চারণ ভূমিতে গ্রামের সবার ভূমি আছে। সবাই গো-চারণের জন্য ওই ভূমি ব্যবহার করছেন। এ ভূমি চাষাবাদের আওতায় চলে গেলে গরু চড়ানোর জায়গা থাকবে না। এই বাধায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সালেহ রেজাসহ কয়েকজন। প্রথমে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। এরপর গত ৩রা ফেব্রুয়ারি এই ভূমি নিয়ে সিলেটের এডিএম কোর্টে মামলা করেন এলাকার অর্ধশতাধিক মানুষ। এই মামলার পর গোয়াইনঘাট এসিল্যান্ড যে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন সেখানে সত্য বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু ভূমি দখলে নিতে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন বাহিনীর কাছে দৌড়াতে থাকেন। গ্রামের মানুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করতে থাকেন। এই অবস্থায় এডিএম কোর্টের শান্তি-স্থিতিবস্থায় রায়কে অমান্য করে ১৩৫ বিঘা ভূমিতে চাষাবাদ শুরু করলে এপ্রিল মাসে হাইকোর্টে যান গ্রামের মানুষ। বর্তমানে জমিটির ওপর আদালতের স্থিতাবস্থা রয়েছে বলে গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন। কিন্তু ওই ভূমি নিয়ে বিরোধের বিষয়টি গোটা গোয়াইনঘাট উপজেলায় আলোচিত হয়। ভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যেই গোয়াইনঘাট থানার এসআই আল-আমীনের সহযোগিতায় হাজী আব্দুস শুকুর ২১ শে মে গোয়াইনঘাট থানায় সালেহ রেজাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকার একটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি ঘটনার তারিখ দেখিয়েছেন ২৫শে মার্চ।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- একই গ্রামের সুলেমান আহমদ, ফরিদউদ্দিন, কিবরিয়া, রায়হান আহমদ ও আব্দুল হক। এদের মধ্যে কেউ কৃষক, কেউ ব্যবসায়ী। মামলায় আব্দুস শুকুর নিজেকে একজন ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে জানান- বিন্নাউড়িতে তার ২০০ বিঘা ভূমি রয়েছে। এই ভূমির কাগজপত্র তিনি তদন্তকালে উপস্থাপন করতে পারবেন। তার এই ভূমিতে আসামিরা জোরপূর্বক চাষাবাদ করার পাঁয়তারা করে আসছে। বিষয়টি নিয়ে ভূমির অন্য অংশীদারসহ এলাকার লোকজনকে জানিয়ে রাখেন। এই অবস্থায় ক্ষুব্ধ হয়ে রেজাসহ আসামিরা তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দিলে প্রাণে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। ধর্মগ্রামের সালিশ ব্যক্তিত্বরা জানিয়েছেন- ঘটনার শুরু থেকেই গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ ও এসআই আল আমীন সবকিছুই জানেন। গ্রামের মানুষের মৌখিক ও লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে বারবারই বিরোধপূর্ণ ভূমি পরিদর্শন করেছে পুলিশ। শুরু থেকে পুলিশের রহস্যময় ভূমিকার কারণে গ্রামের মানুষ গো-চারণ ভূমি টিকিয়ে রাখতে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গেছেন। এই অবস্থায় গত ২১শে মে পুলিশ মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা রেকর্ড করে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। এদিকে মামলা দায়েরের পর দিন ২২শে মে স্থানীয় একটি সাংবাদিকের ‘সতর্কতামূলক’ ফোনে দোকান থেকে বের হয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন সালেহ রেজা। এমন সময় শুকুরের ভাই এখলাস ও চাচাতো ভাই সেলিমসহ কয়েকজন তাকে সড়কের উপর ধরে মারধর করে। এ সময় তারা মবও সৃষ্টি করে। এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর পূর্ব থাকা এলাকায়  অবস্থান করা পুলিশ দল নিয়ে থাকা এসআই আল আমীন সেখানে পৌঁছেন। আহত অবস্থায় তিনি রেজাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান। জামিনে বেরিয়ে আসা সালেহ রাজা মানবজমিনকে জানান- আটকের পর আমাকে জানানো হয় চাঁদাবাজি মামলা হয়েছে। এবং সেটিতে আমি আসামি। এর আগে মামলা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এদিকে- সালেহ রেজাকে আটকের ঘটনায় স্থানীয় বারহাল বাজারে উত্তেজনা দেখা দেয়। গ্রেপ্তারের দু’দিন পর এলাকার লোকজন প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে কর্মসূচির ডাক দিতে চাইলে গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল সেখানে ছুটে আসেন। তিনি মামলার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে গোয়াইনঘাটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হয় পুলিশ।

২৮শে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সালেহ রেজা। জেল ফেরত সালেহ রেজাকে বারহালসহ এলাকার শত শত মানুষ সাদরে বরণ করেন। সালেহ রেজা জানান- জামিনে বেরিয়ে এসে গোয়াইনঘাট বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করেন। ওসি নিজেও মামলা সম্পর্কে জেনেছেন। তিনি শিগগিরই ফাইনাল রিপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে মামলা থেকে দায়মুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন। ওসির কথা আশ্বস্ত হয়ে আমরাও এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায়ে কাজ করছি। গোয়াইনঘাট থানা ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ঘটনাটি সম্পর্কে জেনেছি। ঈদের পর মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান- পুলিশ শান্তি চায়। মানুষের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে ব্যাপারে বর্তমানে গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ কাজ করছে।