Image description

বিগত বছরগুলোতে জলাবদ্ধতা কমানোর জন্য বিভিন্ন নগর এলাকায় নেয়া ড্রেনেজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু নগর এলাকায় জলাবদ্ধতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি, কোন কোন এলাকার অবস্থা আরো অবনতির দিকে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকাসহ জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়েছেন খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা শহরের মানুষ।

মঙ্গলবার (৩ জুন) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) অনলাইনে মতামত “আগাম বর্ষায় নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা: আইপিডির পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে এসছে।

অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রাম শহরে প্রথম কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে কিছুটা কম জলাবদ্ধতা থাকলেও গত কয়েকদিনে বেড়েছে জলজট। খাল, পুকুর, জলাশয়, জলাধারসমূহের প্রাকৃতিক প্রবাহ ও আন্তসংযোগ বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম ড্রেনেজের উপর নির্ভর করে আমাদের নগরে বর্ষার বৃষ্টিপাতকে মোকাবেলা করা যাবে না। ফলে নগর পরিকল্পনার সাথে ড্রেনেজ পরিকল্পনার সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান কৌশল বের করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করবার পাশাপাশি জলাশয় দখলদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।

 

তারা বলেন,খাল-জলাশয় দখলদারদের আইনের আওতায় আনবার পাশাপাশি নগরে জলাবদ্ধতা কমাতে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য প্রয়োজন। কারণ দখলদারেরা সবসময়ই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় প্রশয়েই থাকে সবসময়। সরকার বদল হলেও দখলদারেরা আইনের হাত থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন এখনো।

 

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগর এলাকায় বিগত বছরগুলোতে খাল সংস্কার ও পুনরুদ্ধার, ড্রেনেজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প নেয়া হলেও অল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহসহ অনেক নগরেরই বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আবার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেবার ফলে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। ঢাকা শহরেও খাল উদ্ধারে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিপরীতে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল আবার ভরাট শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের ৩০ কোটি টাকা পানিতে গেছে।

 

তিনি বলেন, কালুনগর, জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর খাল নিয়ে প্রায় নয়শত কোটি টাকার পরিকল্পনার অগ্রগতি খুবই সামান্য। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়া, মেয়র-কাউন্সিলরের অনুপস্থিতির কারণেও অনেক নগর এলাকায় বর্ষার সঠিক প্রস্তুতির অভাব ছিল। অনেক নগরীতেই নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক ও নগরের প্রান্তসীমায় বাস করা নাগরিকেরা জলাবদ্ধতায় পর্যুদস্ত হয়েছেন। ফলে জলাবদ্ধতার ক্ষেত্রেও নিম্ন আয়ের লোকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, আছে এলাকাভিত্তিক বৈষম্যও।

 

পরিকল্পনা ও আইন-কানুনকে তোয়াক্কা না করে নিচু এলাকা ও জলাভূমিতে পরিকল্পনাহীন ও স্বেচ্ছাচারী আবাসনের কারণেও নগর এলাকার পানি নামতে পারছে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর খাল-জলাশয় দখলের কারণে কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি। পরিবেশগত হত্যার মতো বিষয়কে যেন দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ফলে খাল দখলদাররা এখন আরও প্রবল প্রতাপে অনেক জায়গায় ভিন্ন চরিত্রে ফেরত এসেছে।

 

অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বড় শহরগুলোর জলাবদ্ধতার বিশ্লেষণ করে আইপিডির পক্ষ থেকে জলজটের প্রধান কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- নির্বিচারে খাল, পুকুর, জলাশয় দখল ও ভরাট, অপরিকল্পিত ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল-নদী এবং কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থার আন্তঃসংযোগ নষ্ট হয়ে পড়া, নিচু ও জলাভূমি এলাকায় নগরায়ন ও আবাসন, ক্রমাগত রাস্তা উঁচু করে ফেলা, নগর পরিকল্পনা ও ড্রেনেজ পরিকল্পনার ঘাটতি, নগর সংস্থাসমূহের তদারকির গাফিলতি, বর্জ্য ফেলবার ক্ষেত্রে জনগণের অসচেতনতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব অন্যতম।

 

নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা কমাতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পানি প্রবাহের পথ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি করা ও জনগণকে সচেতন করা, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খালের ব্যবহার, নগর এলাকায় সবুজ এলাকা ২৫ শতাংশ ও জলাশয়-জলাধার এলাকা ১০-১৫ শতাংশ এবং কংক্রিট এলাকা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ রাখা, পুকুর জলাধার জলাশয় রক্ষা করা ও প্রয়োজনে নতুনভাবে তৈরি করা, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা, জিআইএস-ওয়াটার মডেলিংসহ আধুনিক ড্রেনেজ ও নগর পরিকল্পনার সমন্বয়, নগর সংস্থাসমূহে কারিগরি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ ড্রেনেজ বিভাগ তৈরি করা, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও আইনের প্রয়োগ, খাল দখলদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের দায়বদ্ধ করা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা, প্রকৌশল, ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি অংশগ্রহণ, নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কার্যকর মিথস্ত্রিয়া নিশ্চিত করা।

 

অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজালাল মিশুক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নগর সংস্থাসমূহের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে এবং চলমান ড্রেনেজের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রামের ৫৭টি খালকেই পুনরুদ্ধার করে সচল করতে হবে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানকে অনুসরণ করে নগরায়ন নিশ্চিত না করবার পরিণতি হচ্ছে শহরের জলাবদ্ধতা।

 

জুরাইনের পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমান মিজান বলেন, জুরাইন-শ্যামপুর এলাকার জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। ডিএনডি এলাকায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলেও জলাবদ্ধতা কমেনি। এখনো সবাই প্রকল্প আর টাকার ভাগ নিয়ে আগ্রহী। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও সেই পুরাতন বন্দোবস্ত দেখা যাচ্ছে। খালের আবর্জনা দূর করবার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই, যার মাধ্যমে অনেক এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করা যেত।

 

খুলনা থেকে পরিকল্পনাবিদ শেখ আদনান ইসলাম বলেন, খাল জলাশয় দখলের পেছনে অনেক সরকারি কর্মকর্তার সংযোগ আছে। তাদের দায় মুক্তির বিধান বাতিল করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। ময়ূর ও ভৈরব নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা দরকার, নদী খনন প্রকল্পের নামে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান কৌশল কাজে লাগাতে হবে। নগর এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদন কমাতে হবে।

 

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আসিফ ইকবাল বলেন, নগরায়ন এখন আবাসন মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত- যারা খাল-বিল উজাড় করে প্রকল্প করেছে। জলাভূমিতে বালু ফেলা হচ্ছে, ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্যাদি সাধারণ মানুষের কাছে জানানো হয় না। অথচ প্রকল্পের নামে লোপাট হয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আমাদের এখন প্রয়োজন জনবান্ধব নীতি।

 

ময়মনসিংহ থেকে পরিকল্পনাবিদ ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল বলেন, আবাসন প্রকল্পের কারণে ময়মনসিংহে অনেক খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ৭ ফুট রাস্তার পাশে নির্মিত হচ্ছে ১৬ তলা ভবন, অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

 

কুমিল্লা থেকে পরিকল্পনাবিদ ইবতেছাম রাশেদিন নাজলা বলেন, কুমিল্লার পুকুরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জলাবদ্ধতার সময় ড্রেনগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণফাঁদ।

 

পরিকল্পনাবিদ আব্দুল আহাদ নাফিস বলেন,খাল-বিলের শহর বরিশালে খালকে বক্স কালভার্টে পরিণত করা হচ্ছে।

 

পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, শ্যামাসুন্দরী খালের সাথে ঘাঘট নদীর সংযোগ অকার্যকর হয়ে পড়ায় রংপুর শহরে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।

 

আইপিডির আলোচনা অনুষ্ঠানে নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা কমাতে পরিকল্পনা, প্রকৌশল, ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জনসচেতনতা, সুশাসন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ঐক্যমত্যের বিষয়টিও উঠে আসে।