
অবশেষে শর্তসাপেক্ষে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে বিএনপিসহ সব দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে অর্থবিল, আস্থাভোট ও সংবিধান সংশোধন। এ তিনটি বিষয় ছাড়া সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবেন। অর্থাৎ দলের বিরুদ্ধেও ন্যায়সংগত কথা বলতে কোনো বাধা থাকবে না।
তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপি আরও একটি বিষয় যুক্ত করেছে। সেটি হলো জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়। দেশে যুদ্ধাবস্থাসহ জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দলের সংসদ-সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বা কথা বলতে পারবেন না। এ ব্যাপারে সবাই একমত না হলে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বিষয়টি দলীয় ইশতেহারে যুক্ত করবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দিনব্যাপী দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের এভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন।
ঐকমত্য কমিশনের এ বৈঠকে বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ঈদের পর ফের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ছাড়াও বৈঠকে এজেন্ডা ছিল নিম্নকক্ষে নারী আসন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্ধারণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধির একটি অংশ।
এদিকে আলোচনা হলেও এ বৈঠকে ঐকমত্য হয়নি তিনটি বিষয়ে। বিষয়গুলো হলো- বিরোধী দল থেকে সংসদীয় সব স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ দেওয়ার প্রস্তাব, নারী আসনে ভোটের পদ্ধতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সররকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি সংক্রান্ত সুপারিশ।
আলোচনার শুরুতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব মতামত দিয়েছে তার ভিত্তিতে পরিবর্তিত প্রস্তাব নিয়েই রচিত হবে জাতীয় সনদ।
সব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে না। কিছু জায়গায় একমত হব। বাকিটা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে সেটা তাদের বিষয়।
জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে আমরা যেন ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি।
এ সময় কমিশনের সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ-সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। সেখানে বলা আছে, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন সংসদে তার আসন শূন্য হবে। দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের এই ধারা সংশোধনের দাবি রাজনৈতিক মহলে। ঐকমত্য কমিশনও সংবিধান সংশোধনে এই প্রস্তাব করে।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এবং উপমহাদেশের চর্চা বিবেচনা করে তার দলের পক্ষ থেকে উপযুক্ত মত হচ্ছে, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আস্থা ভোট না থাকলে সরকার পরিচালনায় স্থায়িত্ব থাকবে না। প্রতিনিয়ত সরকার পরিবর্তিত হতে থাকবে, যা শোভনীয় হবে না। আস্থা ভোট, অর্থবিল এবং সংবিধান সংশোধন ছাড়া সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত প্রদান করবেন, এতে বিএনপি একমত। তবে তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে তার দল আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনসহ এতে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এর বাইরে সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে। যদি কোনো সময় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে যাতে পার্লামেন্ট মেম্বাররা তার জন্য ভোট দিতে পারে, সেটা ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমরা নোট অব ডিসেন্ট দেব।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল, আস্থা ভোট ও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ-সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে বিষয়গুলো তাদের প্রস্তাবে রেখেছে।
তিনটি প্রস্তাবের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমপিদের দলীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল বিএনপি। এ বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. তাহের বলেন, জরুরি পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবিলা করা হবে। কিন্তু আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের তিনটি প্রস্তাবিত বিষয়ে মত দিয়েছি।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক সারোয়ার তুষার বলেন, অর্থবিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট থাকতে হবে, কারণ সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতা যেমন দরকার, তেমনি সরকারের স্থিতিশীলতা দরকার।
এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও চায় এনসিপি। আপত্তি বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের। ঐকমত্য হয়নি দুই ইস্যু নিয়েও। নারী আসনের ভোটের পদ্ধতি আর সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিয়ে বিভিন্ন দল নানা ধরনের প্রস্তাব দেয়। যা নিয়ে ঈদের পরে আরেক দফা আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তার দল চায় না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। তিনি বলেন, তার দল মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি হওয়া উচিত না। যদিও কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, তার দল সংসদের সব স্থায়ী কমিটির প্রধানদের পদে বিরোধী দল থেকে দেওয়ার ব্যাপারে একমত নয়। কয়েকটি কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে করা যেতে পারে। সব স্থায়ী কমিটির প্রধান বিরোধী দল থেকে দেওয়াকে তারা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব মনে করে না। বিএনপি এখনও নারী আসন নিয়ে আলোচনা করেনি বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আমাদের প্রস্তাবনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, জাতীয় নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করা উচিত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও যদি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হয় সেটা ভালো হবে। কিন্তু টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আপাতত নীতিগতভাবে এটার সঙ্গে একমত আছি।
তিনি বলেন, তিন মাস হোক আর চার মাস হোক, এটার নাম হতে হবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। মেয়াদ চার মাস কিংবা তিন মাস যেটাই হোক আমরা এ ব্যাপারে ফ্লেক্সিবল (নমনীয়) থাকব। তবে যদি স্থানীয় সরকার অন্তর্ভুক্ত হয় সেক্ষেত্রে চার মাস প্রয়োজন হতে পারে।
এদিনের আলোচনায় অংশ নেয় ৩০টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, আমজনতার দল, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট।