
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমিয়ে যে বাজেট অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দিলেন, তাতে মূল্যস্ফীতি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে স্পষ্ট কোনো লক্ষ্যের কথা তিনি বললেন না।
বাজেটের আগে সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে বলা হচ্ছিল মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হতে পারে।
তবে সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব দিলেন, সেই বাজেট বক্তৃতায় এ দুটি বিষয় এক প্রকার এড়িয়ে যাওয়া হল।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
“আশার কথা হল, এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।”
“ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে ৩.৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।”
বাজেট বক্তৃতায় আরেক জায়গায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে।”
গতবছর বাজেটের সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দুমাস ধরে চলা সেই আন্দোলন আর সহিংসতায় দেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়।
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ডিসেম্বরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) প্রথম আট মাসের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে অর্থনীতির আকার বাড়তে পারে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। কোভিড মহামারীর শুরুর অর্থবছর বাদ দিলে গত ৩৪ বছরের মধ্যে এটা সর্বনিম্ন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরা হত। তবে অনেক অর্থনীতিবিদের মত বর্তমান সরকারেরও অভিযোগ, সে সময় তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি হত। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য দেখানো হত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে।
তবে ২০০৫-২০০৯ সময়ে বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা সালেহউদ্দিন আহমেদ সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছেন।
অর্থনীতিবিদদের অনেকে প্রবৃদ্ধির হারকে অর্থনীতির গতিশীলতা হিসেবে মানলেও টেকসই উন্নয়নের সূচক হিসেবে মানতে নারাজ। তারপরও অর্থনীতির এই প্রপঞ্চটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার আলোচনায় এসেছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর আসে মহামারী। তার মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিল তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ইকোনোমিক রিভিউয়ের তথ্য অনুসারে, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল এর চেয়ে কম, তিন দশমিক ২৪ শতাংশ।
মহামারীর ধাক্কা সামলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। দুঃসময় কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ।
এরপর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে অর্থনীতির আকার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরেছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হলেও তা অর্জন হয়নি। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ওই অর্থবছর শেষে স্থির মূল্যে জিডিপি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা যখন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করল তখনই শুরু হল ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে ফের টালমাটাল করে দেয়, আবার অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে অর্থনীতি।
বিশ্বের সব দেশকেই কমবেশি এর জের টানতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়, চড়ে যায় ডলারের বিনিময় হার। তাতে পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
তারপরও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু অর্জনের খাতায় যোগ হয়েছে ৪ শতাংশের কম।
পরিসংখ্যা ব্যুরোর সাময়িক হিসাব বলছে, বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপিতে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের চেয়ে কিছুটা কমেছে। কৃষি খাতে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।
এবার প্রবৃদ্ধি কমবে, এমন পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগেই দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৩ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।
নতুন বাজেটে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর আকার ছিল ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেই লক্ষ্য পূরণ করা যায়নি। ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ মাস মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মে থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১২ মাসে মূল্যস্ফীতির চলন্ত গড় দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২১ শতাংশে, যা বহু দশকের মধ্যে বেশি। তাতে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। পরের চার মাস অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে ছিল। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
তবে সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। এর মধ্যে গতবছর জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠে যায়, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সবশেষ এ বছর এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে।”