Image description
সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে জটিলতা

৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে সংবিধান-সংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি। এর মধ্যে ১০টি প্রস্তাবে ঐকমত্য বা আংশিক ঐকমত্যে পৌঁছেছে দলগুলো। ফলে সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। যে ১০টিতে দল ও জোট একমত বা আংশিক ঐকমত্যে পৌঁছেছে সেখানেও একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- তা স্পষ্ট নয় কমিশনের কাছে।

জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এরই মধ্যে দল ও জোটগুলোর সঙ্গে প্রথম দফার আলোচনা শেষ করেছে কমিশন। শিগগিরই দ্বিতীয় দফার আলোচনা শুরু হবে। যেসব ইস্যুতে আংশিক ঐকমত্য রয়েছে সেসব ইস্যুতে একমত করার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছে কমিশন। সংবিধান-সংক্রান্ত যেসব বিষয়ে ঐকমত্য বা আংশিক ঐকমত্য আছে তার মধ্যে আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে কোনোরকম দ্বিমত নেই। সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এই চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে। নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার সম্প্রসারিত করা এবং সেগুলোর কিছু কিছু বিষয় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। তবে এই অধিকারের তালিকা এবং তার প্রয়োগে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা এবং বিশেষ করে তার মাত্রা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে উভয়ই আইনসভার ব্যাপারে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে। উচ্চকক্ষ গঠনকে সেসব দল সমর্থন করে তারা ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে একমত। তবে এই প্রতিনিধিদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের সুপারিশে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। 

সংবিধানের ৪৮ (ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধান তা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হলেও, কী কী বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে তার একটি আংশিক তালিকার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে অর্থ বিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলের ব্যাপারে। দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত। এর অতিরিক্ত আরও কিছু যুক্ত করার যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিল যুক্ত করার জন্যও কিছু দলের প্রস্তাব আছে। আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব পদ বিরোধীদলের সংসদ সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, এই তালিকা থেকে স্পষ্ট- বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে- এ ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে। তবে এসব বিষয়ে অনেক দলই আরও আলোচনার কথা বলেছেন এবং আলোচনায় নমনীয়তা দেখিয়েছেন।