
বাজেট বলতে সাধারণ মানুষ যেটা বোঝে সেটা হলো- চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমবে কি না। ব্যবসাবাণিজ্য সহজ হবে কি না? বাস ভাড়া, বাসা ভাড়াসহ জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে এরকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না? ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে সরকার কেটে নেবে কি না এবং সর্বোপরি সংসার চালানোর খরচ কমবে কি না? সাধারণ মানুষ এর বাইরে বাজেট নিয়ে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা করে না। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বরং এবারের বাজেটে জনসাধারণের প্রত্যাশা আরও বেশি। কেননা তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৬ বছরের অপশাসনের অবসান ঘটে গত বছরের ৫ আগস্ট। এরপর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাচ্ছে। যেহেতু এ সরকারের কাছে জনমানুষের প্রত্যাশা বেশি। ফলে আসছে বাজেটে জনপ্রত্যাশার চাপ অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এবারের (২০২৫-২৬) বাজেটটি হবে জনবান্ধব। যা সত্যিকার অর্থে জনমানুষের কল্যাণে আসবে। অন্যদিকে বিশ্লেষক এবং অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু সম্পদের স্বল্পতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক সংকট, আইএমএফের চাপ, চলমান সংস্কার কার্যক্রম, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ, সামাজিক সংকটসহ হাজারো রকমের অস্থিরতার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বাংলাদেশের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে আজ। এত সব চাপের মধ্যে জনগণের আকাক্সক্ষা বাজেটে কতটুকু উঠে আসবে সেটাই বড় প্রশ্ন। যদিও আর্থিক সংকট বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবার বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনা হয়েছে। কেননা বিদায়ি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নেরও বেহাল দশা বিরাজ করছে। বিশেষ করে রাজস্ব খাতের ঘাটতি লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এবারের বাজেটে সরকার প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। অনেক আগে থেকেই দেশে বিরাজ করছে চড়া মূল্যস্ফীতি। যার ফলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমছে অব্যাহতভাবে। তারপর আগামী বাজেটে সাধারণ করদাতাদের আয়করে বড় কোনো ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেই সরকারের। এনবিআর ও অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমায় কোনো পরিবর্তন আসছে না। অর্র্থাৎ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। যদিও বাজেট প্রস্তুতি শুরুর প্রথম দিকে এটা বাড়ানোর পক্ষেই মতামত দিয়েছিল অর্থ বিভাগ। বরং আয় বাড়ানোর জন্য করমুক্ত আয়সীমা একই রকম রাখার মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে বাড়তে পারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর। অর্থাৎ করপোরেট করহার বাড়ানো হতে পারে। এতে বাড়বে ব্যবসার খরচ। যা দিনশেষে কর্মসংস্থানের ওপর আঘাত হানবে। পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রেও বাড়বে করপোরেট করহার।
সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে- অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আজ সোমবার বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেকর্ডকৃত ভাষণ সম্প্রচারের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটা হবে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। দেখা যাচ্ছে, সরকার বাজেটে কর খাতে বড় কোনো পরিবর্তন আনছে না। শুধু তাই নয়, অনেক দিনের রীতি ভেঙে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে সোমবারে বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। সূত্র জানায়, রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য বেছে কিছু খাতে নতুন করে করারোপ করছে সরকার। তবে কর ছাড়ের জায়গা আগের মতোই সীমিত থাকছে। একইভাবে বারবার কর নেট বাড়ানোর নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। এবারের বাজেটেও এমন কোনো উদ্যোগ থাকছে না। তবে আগামী অর্থবছরে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দেখানোয় বড় ছাড় আসছে।
বর্তমানে ৪৫ ধরনের সেবা নিতে আগের অর্থবছরের রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র লাগে। সঞ্চয়পত্র কেনাসহ বেশ কিছু খাতে এ বাধ্যবাধকতা থাকছে না। তবে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকছে। অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। যা চলতি বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এবারই প্রথম স্বাধীনতার পর চলতি বছরের তুলনায় বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে। বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের টার্গেট ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর টার্গেট ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। যদিও চলতি বছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ১৯ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের সারসংক্ষেপের তথ্যমতে, আগামী ২০২৫-২৬ বছরের জন্য অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে মোট ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ এ ঘাটতি পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হতে পারে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হতে পারে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। নানা সংকটের কারণে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এবং মূল্যস্ফীতির চাপকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিটিভিতে সম্প্রচারের পাশাপাশি অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্য অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটেও প্রচার করা হবে। একই সঙ্গে বাজেট ডকুমেন্ট অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যাবে।