
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় তাকে এপিএস পদ থেকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছেন উপদেষ্টা। তদবির বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম-অপকর্মের মাধ্যমে এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে এই কয়েক মাসে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুদক এপিএস মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। দুদকের তলবে এক দফায় তিনি হাজিরাও দিয়েছেন। এপিএসকে চাকরিচ্যুত করার পরে উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে উপদেষ্টা পদ থেকে বাদ দেয়ার দাবি উঠেছিল। মূলতঃ উপদেষ্টার ছত্রছায়ায়ই সকল অপকর্ম চলছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছিল। আর এ কারণেই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি তোলা হয়।
সর্বশেষ জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তিন কর্মকর্তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরা হলেন- উপদেষ্টার পিএস (যুগ্মসচিব) আবুল হাসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসন-১ শাখার উপসচিব মো. আকবর হোসেন এবং প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব ড. মো. মনিরুল ইসলাম। এই তিন কর্মকর্তাই মূলত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে এই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে খোদ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ছত্রছায়ায়ই।
প্রশাসন ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা, উপসচিব মো. আকবর হোসেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে ছিলেন মহা ক্ষমতাধর। আকবর হোসেনের প্রধান পরিচয় হলো তিনি আওয়ামী লীগ আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়, জাতীয় সংসদের চিফ হুইফ নূর ই আলম চৌধুরীর (লিটন চৌধুরী) পিএস ছিলেন। এর পরে স্থানীয় সরকার বিভাগের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদেরও পিএস ছিলেন। উল্লেখ্য, সচিব হেলালুদ্দীন আওয়ামী সরকার পতনের পর গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারান্তরীণ আছেন। জানা গেছে, আকবর হোসেনকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অন্যত্র ইতিমধ্যে চার বার বদলি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি বদলির আদেশ বাতিল করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বহাল রয়ে গেছেন। চিফ হুইপ লিটন চৌধুরীর পিএস পদ থেকে তৎকালীন অত্যন্ত ক্ষমতাধর সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের পিএস হয়ে আসেন তিনি ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি। সেই থেকে এ পর্যন্ত এক নাগাড়ে প্রায় সাড়ে ছয় বছর স্থানীয় সরকার বিভাগেই আছেন। মাঝে দুই দফায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বদলি করা হলে প্রথম দফায় ১৯ দিন এবং দ্বিতীয় দফায় ২৩ দিন সেখানে ছিলেন মাত্র।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলের ক্ষমতাবান এই কর্মকর্তা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে উঠেছেন আরো ক্ষমতাধর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসন-১ শাখার উপসচিব মো. আকবর হোসেন অঘোষিতভাবে এতটা ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন যে, স্থানীয় সরকার বিভাগের সব কাজেই তিনি নাক গলাচ্ছেন। তাঁর সবুজ সংকেত ছাড়া কোনো নথিই সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর অনুমোদন করার ক্ষমতা নেই। প্রতিদিন সচিবের দপ্তরে যেসব নথি আসে প্রত্যেকটিই উপসচিব আকবর হোসেন খতিয়ে দেখেন। তারপর সচিবের টেবিলে যায়। আকবর হোসেন যেভাবে নির্দেশনা দেন সচিব রেজাউল মাকছুদ সেই অনুযায়ীই নথিতে নোট লিখেন অথবা নথি অনুমোদন করেন। উপসচিব আকবর হোসেনের ইচ্ছের বাইরে অন্য কিছু করার ক্ষমতা সচিবের নেই, বলছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অবশ্য, উপসচিব আকবর হোসেনের মহা ক্ষমতাধর হয়ে উঠার নেপথ্যে রয়েছেন উপদেষ্টার পিএস মো. আবুল হাসান এবং উপদেষ্টা সজীব ভুঁইয়া নিজেই। পিএস আবুল হাসান প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা। সম্প্রতি যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তিনি। গত বছরের ১৫ আগস্ট তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পিএস হয়ে আসেন। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তখন ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। পরবর্তীতে ১০ নভেম্বর, ২০২৪ তাকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই থেকে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। আর এর সঙ্গে উপসচিব আকবর হোসেনও মহা ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন পিএস আবুল হাসানের প্রভাবে। আকবর হোসেন এবং আবুল হাসান উভয়েরই বাড়ি সাতক্ষীরায়। বর্তমান আমলে অত্যন্ত ক্ষমতাধর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদেরও বাড়ি একই এলাকায়। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এই উভয় কর্মকর্তারই। এদিকে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ারও অত্যন্ত পছন্দের এই দুই কর্মকর্তা। কারণ, এরা সকল অপকর্মের নাটের গুরু হিসেবে কাজ করছেন। এদের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব ড. মো. মনিরুল ইসলাম। এই তিন কর্মকর্তাই স্থানীয় সরকার বিভাগের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। পিএস আবুল হাসানকে যেহেতু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগসহ আরো অন্যান্য কিছুও দেখতে হয় তাই তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের অনিয়ম-অপকর্মে পুরোপুরি নজর দিতে পারেন না। ড. মো. মনিরুল ইসলাম এবং আকবর হোসেন- এরা দু’জনই সবকিছু দেখছেন, তবে প্রত্যেকটি বিষয়ই পিএস আবুল হাসানের নজরে এনে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, এই চক্রের সঙ্গে সমঝোতা না হলে বা তাদের মনঃপূত না হলে কোনো নথিই অনুমোদিত হয় না। সচিবের টেবিলে যাওয়ার আগেই এ বিষয়গুলো ফায়সালা করতে হয়। তা নাহলে সচিবের টেবিল থেকে নথি নেতিবাচক মন্তব্যসহ ফেরত আসে। এ কাজগুলো ফায়সালার দায়িত্বে আছেন উপসচিব আকবর হোসেন। রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর যদিও একজন পিএস আছেন। এবং নিয়ম অনুযায়ী সচিবের টেবিলে যাওয়ার আগে নথিগুলোর প্রত্যেকটির বৃত্তান্ত পিএস’রই দেখার কথা। কিন্তু স্থানীয় সরকার সচিবের পিএস মো. আব্দুল্লাহ্-আল-নোমান সরকার এ বিষয়ে মোটেই ক্ষমতাবান নন। নথির বিষয়ে সচিবকে ব্রিফ করার ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়নি। সচিবের নিজেরই কোনো ক্ষমতা নেই এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে নথিতে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে দুর্নীতির দায়ে অব্যাহতি দিলেও মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি-অপকর্মের প্রবণতা মোটেই কমেনি। স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের সময়ই এই সিন্ডিকেটকে শতকরা ১০ ভাগ কমিশন দিতে হচ্ছে। যে কারণে অধীনস্থ দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে প্রকল্পের প্রস্তাব আসার প্রবণতা অনেকটাই কমে গেছে। ইতিপূর্বে ওয়াসায় নিয়োগ কেলেঙ্কারিসহ যেসব অনিয়ম-অপকর্মের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে প্রত্যেকটিতেই এই সিন্ডিকেট ছিল মূল ভূমিকায়। এপিএস মোয়াজ্জেমের অব্যাহতির পর এদের বরং সুবিধাই হয়েছে। ইতিপূর্বে এপিএস মোয়াজ্জেম থাকাকালে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মাঝেমধ্যে মতবিরোধ তৈরি হতো। এখন নিজেরা সমঝোতায় সবকিছুতেই খবরদারি করতে পারছেন, এটাই তাদের লাভ।
শীর্ষনিউজ