
বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইজারা নেওয়া ভূমির জন্য লাইসেন্স ফি এক লাফে ছয় গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, যাচাই-বাছাই ছাড়া এমন প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রেলের একটি বড় অংশ ইজারাকৃত ভূমি অবৈধ স্থাপনায় পরিণত হতে পারে এবং আইনি জটিলতায় রেলওয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাতে পারে।
প্রস্তাবিত ‘ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২৫’-এর খসড়ায় দেখানো হয়েছে, ২০২০ সালে যেখানে ‘ক’ শ্রেণির খোলা জায়গার জন্য ফি ছিল প্রতি বর্গফুটে ১০০ টাকা, সেখানে তা বাড়িয়ে ২০২৫ সালে ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আচ্ছাদিত স্থানে ফি ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে। অন্য শ্রেণিগুলোতেও ৩ থেকে ৬.২৫ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি রেলভূমি ইজারা নিয়ে বাণিজ্য পরিচালনা করছেন, তারা পূর্ববর্তী নীতিমালার আওতায় নির্ধারিত ফি নিয়মিত পরিশোধ করে বৈধ লাইসেন্সধারী হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন; কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুসারে যদি ফি হঠাৎ করে পাঁচ-ছয় গুণ বৃদ্ধি পায়, অনেকেই সেই ফি পরিশোধে অক্ষম হবেন। ফলে তারা নিয়মিত ফি জমা না দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারবেন না। এতে তাদের অবস্থান ‘অবৈধ দখল’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে রেলওয়ে আদালতের মুখোমুখি হতে পারে এবং পুরো ব্যবস্থাপনা জটিলতায় পড়তে পারে।
চট্টগ্রামের রেলভূমির লাইসেন্সধারী আবুল মনসুর বলেন, ‘আলোচনা ছাড়াই একতরফাভাবে লাইসেন্স ফি অবাস্তবভাবে বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে। অনেক কৃষকেরও কষ্ট হবে টাকা পরিশোধ করতে। এসব বিষয়ে আমাদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।’
ঢাকার রেলভূমির লাইসেন্সধারী মো. বাবুল চৌধুরী বলেন, ‘ভাড়া অবাস্তব হলে আমরা কোর্টে যাব। এতে রাজস্ব হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অবৈধ দখলদাররা বরং উৎসাহিত হবে। মনে হচ্ছে পুরোনোদের চাপ দিয়ে নতুনদের জন্য জায়গা খালি করার চেষ্টা চলছে।’
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম বলেন, ‘এটি এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। আগামীকাল সোমবার রেল ভবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক রয়েছে, যেখানে রেলওয়ে মহাপরিচালক, পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টরা অংশ নেবেন। সব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন খাতে রেলের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যাত্রীদের ভাড়া বাড়ানো যাচ্ছে না, তাই ল্যান্ড রেন্ট রিভিউ করাটা স্বাভাবিক। তবে কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত হবে।’
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীন জানান, ‘ডাবল ভাড়ার প্রস্তাব থাকলেও তা বাস্তবায়ন না-ও হতে পারে। বৈঠকে উভয় অঞ্চলের কর্মকর্তারা যুক্ত থাকবেন এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তখনই হবে।’
খসড়া তৈরি হয়েছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, মাঠপর্যায়ে মতামত নেই: রেল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালার খসড়া মূলত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তৈরি হয়েছে, যেখানে মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। ফলে বাস্তবতাবিবর্জিত অনেক প্রস্তাব খসড়ায় স্থান পেয়েছে।
রেলের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকৌশল ও সরবরাহ খাতে ব্যাপক ব্যয় ও অনিয়মকে আড়াল করতে ভূমি খাতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে প্রভাবশালী মহল। এতে রেলের প্রকৃত আয় না বাড়লেও সরকারের চাপ সাময়িকভাবে এড়ানো যাবে বলে তারা মনে করছেন।’
রাজস্ব ঝুঁকি ও সামাজিক প্রভাব: বর্তমানে রেলের ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমির মধ্যে ১৪ হাজার ৪৭৩ একর ইজারার আওতায় রয়েছে, যেখান থেকে রেলওয়ে প্রতি বছর বিপুল রাজস্ব পায়। দেশের ৪৯৩টি রেলস্টেশন এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক কৃষক রেলভূমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। হঠাৎ ফি বাড়লে এই মানুষগুলোর জীবন জীবিকায় বড় ধাক্কা আসবে।
তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১ টাকা আয় করতে রেলওয়ের আড়াই টাকারও বেশি ব্যয় হয়। এই ব্যয় সামাল দিতে সরকারের চাপ রয়েছে। সেই চাপ যেভাবে লাইসেন্সধারীদের ওপর চাপানো হচ্ছে, তা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।