Image description

গত ৯ মে দিনগত রাত সোয়া ১২টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে খুন হন মো. জয় (১৫) নামের এক কিশোর। খেলাধুলা নিয়ে সামান্য কথাকাটাকাটির জেরে ওইদিন রাত ১০টার দিকে উপজেলার লোহাগাছ এলাকায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। নিহত জয় দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গত ১৮ এপ্রিল বাড়ির পাশে বাঁশের মাচা তৈরি করতে গিয়ে বাধার মুখে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন বিপুল শেখ (৩৫) নামের এক যুবক। তুচ্ছ ঘটনায় তাকে হাতুড়িপেটা ও কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় শহিদুল ইসলাম ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে।

দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে মানুষ। তুচ্ছ কারণে জড়িয়ে পড়ছে সংঘাতে। সামান্য কথাকাটাকাটি গড়াচ্ছে খুন পর্যন্ত। যেখানে স্বার্থ আর সম্পত্তির দ্বন্দ্ব পুরোনো এক অসুখ। ভ্রাতৃত্ব ও পারিবারিক সম্পর্কে চিড় ধরছে প্রতিনিয়ত। ভাই-ভাইয়ের দ্বন্দ্বে খুন, সন্তানের হাতে বাবা-মা খুন, এমনকি বাবা-মায়ের হাতেও খুন হচ্ছে সন্তান। নিজের তুচ্ছ অপরাধ ঢাকতেও আপনজনকে অনায়াসে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি পুরো বাংলাদেশে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের কিছু সামাজিক ও মানসিক অসুখ পুরোনো। দেশে পারস্পরিক সহনশীল আচরণ, সম্পর্কোন্নয়ন ও সম্প্রীতি ধরে রাখার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। বরং দিন দিন বিভাজন বাড়ছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ভয়ংকর সব হত্যাকাণ্ডের অভিজ্ঞতা। সামাজিক সহিংসতা মানুষের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। চিন্তায় ও জীবনাচরণে বাড়ছে উগ্রতা।

 

এ দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ভ্রাতৃত্ববোধ, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভাজনের বাইরে গিয়ে মানুষকে আপন করে নেওয়ার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করতে হবে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে ফেস করার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কে কার অনুসারী সেই বিভাজন না করে সবাইকে আপন করার বোধ তৈরি করতে হবে।- অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক

সম্প্রতি রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকায় মাত্র তিন হাজার টাকা চুরি করতে দেখে ফেলায় দুই খালাকে খুন করেছে তাদের আপন ভাগনে। সাভারে অপকর্ম দেখে ফেলায় বাবাকে খুন করেছে মেয়ে। তুচ্ছ বিষয়ে কথাকাটাকাটির জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে বাবা-মা-চাচি মিলে সন্তানকে হত্যা করেছে। এছাড়া আধিপত্য রক্ষায় কিশোর বয়সেই হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাতে দেখা যাচ্ছে।

গত জানুয়ারিতে অনলাইন জুয়ার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে চুরির ঘটনা দেখে ফেলায় গৃহকর্মীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবির হোসেন রাফির বিরুদ্ধে। সবশেষ রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের বাসা থেকে বুধবার (২৮ মে) দুপুরে এক দম্পতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় একজন গ্রেফতার হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, গ্রেফতার ব্যক্তির সঙ্গে নিহত নারীর পরকীয়া সম্পর্ক ছিল, তার জেরেই এই হত্যাকাণ্ড। নিহতরা হলেন- ওই বাসার সাবলেট ভাড়াটিয়া পাপ্পু (৩১) ও তার স্ত্রী দোলা (২৯)। গ্রেফতার ব্যক্তির নাম গাউস মিয়া।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সময়ে আমরা যে অপরাধগুলো দেখছি এ ঘটনাগুলো ঘটছে তুচ্ছ কারণে। কিন্তু এটির পরিণাম ভয়ানক। এর পেছনে বড় কারণ- বছরের পর বছর মানুষের মধ্যে অস্থিরতা থাকছেই। শ্রেণি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রার সুযোগ নেই। ব্যক্তির সামাজিকভাবে সুস্থতা ও মানবিক অনুভূতি নিয়ে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণে বড় ঘাটতি আছে।’

‘সুযোগ সুবিধার দিক থেকে, জীবনমানের উন্নয়নের দিক থেকে, পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখা এবং আর্থিক নিশ্চয়তার প্রশ্নে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরিবর্তিত অবস্থায় গার্মেন্টস সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরতদের বড় একটা অংশ বেকার হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রে নানাবিধ অনিশ্চয়তা তো আছেই। কখন কী ঘটবে, বাইরের কর্মপরিবেশে সবসময় চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়, বেশ কিছু প্রশ্নও তাড়া করে। এসব কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়।’

এ অপরাধ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, ‘এসব ঘাটতির ফলে ছোট ছোট সমস্যা মেনে নেওয়া এবং সমাধানের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে আমিত্বের লড়াই চলে। সহনশীলতার পরিবর্তে কে কার চেয়ে বড়, এটি প্রমাণের জন্য একজন আরেকজনের ওপর হামলে পড়ে। সম্পদ নষ্ট করা, হুমকি দেওয়া ও নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়। উদারচিত্তে নিজের বা অন্যের ভুলত্রুটি সমাধানের প্রস্তুতি নেই।’

‘সমাজে এমন সমস্যা চলতে থাকলে সেখানে সুস্থ আচরণধারা তৈরির জন্য যে অবস্থা বা প্রেক্ষাপট থাকতে হয়, সেটিও অনুপস্থিত। ফলে ব্যক্তি দ্রুত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। নিজেকে জাহির করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে হত্যা বা হানাহানির মতো পরিবেশ তৈরি করছে।’

ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কগুলোর মধ্যেও দায়িত্বশীল আচরণের ঘাটতি দেখছি। সামাজিক দায়িত্বশীলতা, মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে চলা—এসব শিক্ষা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তৈরিই হয়নি। একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে তাকে মোকাবিলা করতে হয়, এটি আমরা শেখাতে পারিনি বা অভ্যস্ত করতে পারিনি। যে কারণে এসব ব্যাধি থেকে রাতারাতি সমাধান পাওয়া যাবে না।’

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানুষকে ফেস করার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কে কার অনুসারী সেই বিভাজন না করে সবাইকে আপন করার বোধ তৈরি করতে হবে। মানুষের সামাজিক মর্যাদার বিভেদের মূলে যে অর্থ ও ক্ষমতা; রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে দূরত্ব গোছাতে হবে। ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য ব্যক্তিকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকতে হবে। অপরাধের বিচার যত নিষ্পত্তি করা গেলে কিছুটা হলেও সংকট থেকে পরিত্রাণ মিলবে।’

যে যাকে পারছে ধরছে, মারছে, দখল করে নিচ্ছে। কেউ কাউকে পরোয়া করছে না। আজকের সামাজিক উগ্রতার উৎসমুখ হতে পারে সেই ক্ষমতার লড়াই। কারণ, সবাই মনে করে তাৎক্ষণিক জিততে হবে। আর পেশিশক্তি দিয়ে সেটা শো করতে হবে।- অধ্যাপক এসএম ইয়াসিন আরাফাত

সামাজিক অস্থিরতা এবং এ থেকে মুক্তির পথ বিষয়ে জানতে চাইলে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এসএম ইয়াসিন আরাফাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘এগুলো চিকিৎসার ইস্যু নয়, সামাজিক ইস্যু। চারপাশে যেসব উগ্রতা তার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের সহনশীলতা কমে গেছে। আমরা জুলাই-আগস্টে যে ভায়োলেন্স দেখেছি, এ অভিজ্ঞতার ফলে ভয়ের মাত্রা কমে গেছে। যে কারণে একজন আরেকজনকে ইচ্ছে হলেই মারছে বা আক্রমণ করছে।’

বিচারব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘দেশে বিচারহীনতার একটি দীর্ঘ সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে। মনে করা হয়, ক্ষমতা থাকলেই বিচারকার্য প্রভাবিত করা যায়। আলোচিত বা বড় কোনো ঘটনা ছাড়া ছোটখাটো অপরাধগুলোর বিচার কবে হবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না।’

‘১৫ বছর ধরে যেটা মনে হয়েছে যে, মানুষ ক্ষমতার মোহে উন্মত্ত হয়ে গেছে। যেখানে সবচেয়ে বড় হয়ে সামনে এসেছে অর্থ এবং পেশিশক্তির ক্ষমতা। যে যাকে পারছে ধরছে, মারছে, দখল করে নিচ্ছে। কেউ কাউকে পরোয়া করছে না। আজকের সামাজিক উগ্রতার উৎসমুখ হতে পারে সেই ক্ষমতার লড়াই। কারণ, সবাই মনে করে তাৎক্ষণিক জিততে হবে। আর পেশিশক্তি দিয়ে সেটা শো করতে হবে।’

বর্তমান এই বাস্তবতায় কীভাবে মানব উন্নয়ন তথা সমাজে সুস্থ ভাবভাবনা ফিরিয়ে আনা যায়- জানতে চাইলে এসএম ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘এসব মোকাবিলায় রাশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী উরি ব্রনফেনব্রেনারের থিউরিতে আসতে হবে। যার একটা থিউরি হলো- ইকোলজিক্যাল সিস্টেম থিউরি। ওখানে একটা সমাজে কত সিস্টেম থাকে; মাইক্রো সিস্টেম, ম্যাসো সিস্টেম, ম্যাক্রো সিস্টেম, ক্রনো সিস্টেম। এই ইন্টারভেনশনগুলো সব সিস্টেম থেকে আসা উচিত।’

 

‘ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সচেতনতা দরকার। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে কিছু নেই। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। সব জায়গা থেকে এগিয়ে না এলে ব্যক্তি পর্যায়ে উত্তরণ কঠিন’- বলেন এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।