Image description

চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। পুরো বন্দরে যে পরিমাণ হ্যান্ডলিং বা ওঠানামা হয় তার প্রায় অর্ধেকই হয় এই একটি টার্মিনালে। বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে মনে করা হয়, কিন্তু বন্দরের মেরুদণ্ড হচ্ছে এনসিটি টার্মিনাল। সম্প্রতি টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে অভিযোগ রয়েছে দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠানের আড়ালে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় ভারত। কারণ, ডিপি ওয়ার্ল্ডে ভারতীয় কর্মকর্তাদেরই আধিপত্য। তাদের মাধ্যমেই বন্দরটিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইছে দেশটি।

যদিও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। বন্দরের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানই প্রথম বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তার মধ্যস্থতায় পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালকে (পিসিটি) সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়েকে আর এনসিটিকে ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়। পিসিটিতে রেড সি গেটওয়ে অপারেশন শুরু করলেও পালিয়ে যাওয়ার আগে এনসিটির নিয়ন্ত্রণ ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে তুলে দিয়ে যেতে পারেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের অসম্পূর্ণ সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সরকারের দাবিÑএনসিটিতে বিদেশি অপারেটর এলে সক্ষমতা বাড়বে বহু গুণে। জানা গেছে, ২০২৪ সালে এই টার্মিনালটিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে প্রায় এক লাখ টিইইউএস। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিয়ে টার্মিনালটি অপারেশন করালে বছরে ১৫ লাখ টিইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে।

এনসিটি টার্মিনালের বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, মাত্র ২ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ানোর জন্য বিদেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। বর্তমান অবকাঠামোতে একটু আধুনিকায়ন ও বন্দরের ভেতর থেকে কন্টেইনার খুলে পণ্য ডেলিভারি বন্ধ করে দিলে ১৬ থেকে ১৭ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব। তরফদার রুহুল আমিন বলেন, টার্মিনালটিকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে সক্ষমতা বাড়ানোর ছোট ছোট এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

ডিপি ওয়ার্ল্ডে ভারতীয় কর্মকর্তাদের আধিপত্য

এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান হলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডে ভারতীয় কর্মকর্তাদের আধিক্য বেশি। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পিঅ্যান্ডও নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানির মালিকানা কিনে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল ডিপি ওয়ার্ল্ড। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয়। ফলে ডিপি ওয়ার্ল্ড ওই বন্দরগুলোর পরিচালনার ভার পোর্ট আমেরিকা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

গত ১৫ এপ্রিল ডিপি ওয়ার্ল্ডের ৩৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিদর্শনে আসে। ১৪ এপ্রিল ওই প্রতিনিধি দলের নামের তালিকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। সেই তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছ, ৩৪ জনের প্রতিনিধিদলের ২১ জনই ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। এক দিনের মাথায় তারা সবাই গেটপাসও পেয়ে যান।

এনসিটির আধুনিকায়নের সুযোগ কতটা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ১৯টি জেটি রয়েছে। এর মধ্যে এনসিটির অধীনে রয়েছে চারটি। যেখানে সমুদ্রগামী জাহাজ চারটি আর অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা ছোট আকারের একটি লাইটার জাহাজ একসঙ্গে নোঙর করতে পারে। জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠা-নামা করানোর জন্য বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রের নাম রেল মাউন্টেড কি গ্যান্ট্রিক্রেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এনসিটির ৯৫০ মিটার এলাকায় গ্যান্ট্রিক্রেন বসানোর সুযোগ আছে ১২টি কিন্তু চাপাচাপি করে বসানো হয়েছে ১৪টি। জাহাজ থেকে নামার পর কন্টেইনার আনা নেওয়ার জন্য যে সব যন্ত্রাংশ প্রয়োজন তার সবই আছে এনসিটির বহরে। বর্তমান অবকাঠামোতে নতুন করে কোনো যন্ত্রাংশ সংযুক্ত করার সুযোগ আপাতত নেই। তবে এসব যন্ত্রাংশ শতভাগ অটোমেশন করলে গতি কিছুটা বাড়বে।

এছাড়া অপারেটিং সিস্টেম সফটওয়ার ফলপ্রসূ করা যাবে। এই সফটওয়্যারের কাজ হলো কন্টেইনারের লোকেশন শনাক্ত করা। ব্যবস্থাটির বর্তমানে কার্যকারিতা নেই। কারণ আওয়ামী লীগ আমলে কাজটি বাগিয়ে নেয় ঢাকার পলাতক মেয়র ফজলে নূর তাপসের ঘনিষ্ঠ মাহবুব জামানের মালিকানাধীন ডেটা সফট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অনভিজ্ঞ হওয়ায় কাজটি ঠিকমতো করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে এখনো অ্যানালগ পদ্ধতিতেই কন্টেইনার শনাক্ত করতে হয় বন্দরকে। ছোট ছোট এই প্রকল্পগুলোর আধুনিকায়ন ছাড়া বর্তমানে এনসিটিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশি অপারেটর এলে লাভ কতটা

পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জেটি ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আধুনিক যন্ত্রাংশসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে আরো ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের শর্তে ২০২৪ সালের জুনে টার্মিনালটি অপারেশনের দায়িত্ব নেয় সৌদি প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী, পিসিটিতে অপারেশন হওয়া প্রতি কন্টেইনারে ভাড়া হিসেবে বন্দর পাচ্ছে ১৮ ডলার করে। বিপরীতে এনসিটিতে প্রতি কন্টেইনারে বন্দরের আয় ৭০ ডলার করে। এর মধ্যে ৬ ডলার নিয়ে যায় টার্মিনাল অপারেটর। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি একক কন্টেইনারে বন্দর পায় ৬৪ ডলার করে।

যদিও এনসিটিতে বন্দরের বিনিয়োগ আছে ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। টার্মিনালটি যদি বিদেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানের হাত যায় তবে চুক্তির ক্ষেত্রে পিসিটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু পিসিটি থেকে এনসিটিতে বন্দরের বিনিয়োগ বেশি হওয়ায় ভাড়া হয়তো পিসিটি থেকে কিছুটা বাড়বে কিন্তু তা কখনোই বর্তমান আয়ের ধারে-কাছে যাবে না বলে মনে করেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

এর বাইরে একটি কন্টেইনার ডেলিভারি নিতে আমদানিকারক চারদিন সময় পান। কিন্তু এই চারদিনে কেউ কন্টেইনার ডেলিভারি নিতে পারেন না। ডকুমেন্টেশনে কোনো ত্রুটি না থাকলেও একটি কন্টেইনার ছাড়াতে ৬ থেকে ৭ দিন লাগে। চার দিন পর কন্টেইনার প্রতি দিনে ২৪ ডলার করে স্টোর রেন্ট পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বছর শেষে গড়ে এনসিটি থেকে প্রতি কন্টেইনারে বন্দর আয় করে ১৩৩ ডলার করে। কিন্তু বিদেশি অপারেটর এলে এই স্টোর রেন্ট পাবে ওই প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়া বন্দরের মাশুল আদায় হয় ডলারে, বিদেশি প্রতিষ্ঠান অপারেশনে এলে ডলারের পুরোটাই তাদের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টে যোগ হবে। পড়ে সেখান থেকে লাভের টাকাটি আসবে বন্দরের অ্যাকাউন্টে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বড় একটি অংশ দেশেই আসবে না।

ডিপি ওয়ার্ল্ডকেই পছন্দ কেন

ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডের অবস্থান পঞ্চম। তার ওপরে আরো ৪টি প্রতিষ্ঠান থাকতে ডিপি ওয়ার্ল্ডকেই একমাত্র পছন্দ কেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। পলাতক আওয়ামী লীগ আমলে সালমান এফ রহমানই ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চট্টগ্রাম বন্দরকে সঁপে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের আগ্রহেই এই প্রক্রিয়া শুরু করেন সালমান এফ রহমান।

আন্তর্জাতিক দরপত্রের পরিবর্তে পিপিপি পদ্ধতি

গ্লোবাল অপারেটরদের দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা করার উদ্যোগ নিলে তা আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে করা যেত। এতে আরো লাভবান হতো বাংলাদেশ। কারণ শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নিলে ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়েও হয়তো ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানের সেবা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দরপত্র হওয়ায় প্রতিযোগিতায় আরো উচ্চমূল্যের সার্ভিস চার্জ পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। এসব প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগ এড়িয়ে শুধু ডিপি ওয়ার্ল্ডকে কাজ দিতেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতি অনুসরণ করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।

উদ্বেগের কারণ ও আন্দোলন

সমুদ্রের মোহনা কর্ণফুলী নদীতে ঢুকতে প্রথমেই শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ে। এর পরেই পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। তারপর কোস্টগার্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়, নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি যেখানে নোঙর করে রাখা হয় যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিন, দেশের প্রধান তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি; বিপণন প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার বিভিন্ন স্থাপনা পার হয়ে পৌঁছাতে হয় এনসিটি বা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে। পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল সৌদি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এনসিটিতে বিদেশি অপারেটর এলে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

আগামী নভেম্বরে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। চুক্তি হয়ে গেলে, বন্দরকে এককালীন কিছু টাকা পরিশোধ করার পাশাপাশি বার্ষিক ও কন্টেইনার প্রতি মাশুল দেওয়ার শর্তে ডিসেম্বর নাগাদ এনসিটির দায়িত্ব বুঝে নেবে ভীন দেশি প্রতিষ্ঠানটি। মাশুল আদায় থেকে শুরু করে লোকবল নিয়োগ সবই নিয়ন্ত্রণ করবে এই প্রতিষ্ঠান। আর এতেই চাকরি হারানোর শঙ্কা ঘিরে ধরেছে বন্দরের শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে। কারণ এনসিটিতে বন্দরের নিজস্ব হাজার খানেক লোকবলের সঙ্গে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আরো ৫ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সরকার বার বার বলছে কারো চাকরি যাবে না, বরং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী নুরুল্লাহ বাহার বলেন, বন্দরের শ্রমিক কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে একটি নিয়মে কাজ করে অভ্যস্ত। আর এই নিয়মে বন্দর ভালো চলছে। এর সক্ষমতা নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্নও নেই। তাই পুরোদমে সচল একটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরকে দিয়ে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান তথা বন্দরকে নিয়ে জুয়া খেলার সুযোগ দেওয়া হবে না।

বিকল্প আছে আরো অনেক

চট্টগ্রাম বন্দরের এই টার্মিনালটি পরিচালনা করছে সাইফ পাওয়ার টেক নামের একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে মনোপোলি ব্যবসা করার পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সাপ্লাই ও সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশি অপারেটরের হাতে বন্দর তুলে দিতে এই ন্যারেটিভও প্রচার করা হচ্ছে।

বার্থ শিপ হ্যান্ডলিং ও টার্মিনাল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে ইকরাম চৌধুরী জানান, সাইফ পাওয়ার ছাড়াও বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের অন্য জেটিগুলো অপারেশনে দেশীয় আরো ছয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা সাইফ পাওয়ারের চেয়ে আরো কঠিন কাজে অভ্যস্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে সরকারি প্রভাব খাটিয়ে আইনের মারপ্যাঁচে ওই একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা টেন্ডারেই অংশ নিতে পারেনি। তাই সাইফ পাওয়ার টেকের বিকল্প খুঁজতে বিদেশে না গিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরাসরি নিজেরাই টার্মিনাল পরিচালনা করতে পারে। বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি বলেন, তারা টার্মিনাল অপারেট করতে পারবে না, তাহলে প্রশ্ন আসবে ডিপি ওয়ার্ল্ড ১২ বছর পর চলে গেলে কে এই টার্মিনাল অপারেট করবে। তাই বন্দরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে এখনই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞ ও বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা ও প্রশাসন পর্ষদের সাবেক সদস্য জাফর আলম জানান, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠা-নামানোর গতি কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু কাস্টমসের আচরণে যদি পরিবর্তন না আসে; ঢাকা-চট্টগ্রাম মাহসড়কে যান চলাচলের সক্ষমতা যদি না বাড়ে, তবে হিতে বিপরীত হবে।

জাফর আলম বলেন, বন্দর ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করার ইচ্ছা থাকলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করেও করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে একমাত্র বিকল্প ভাবার সুযোগ নেই। বিদেশি অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে আনতে হলে মাতারবাড়ী বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল ও লালদিয়ার চড় টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি গ্রিন ফিল্ড পোর্টের দায়িত্ব দিয়ে অভিজ্ঞতা যাচাই করা যেতে পারে।

পোর্ট ও মেরিটাইম বিশেষজ্ঞ মিনার রশীদ বলেন, বাংলাদেশে আমরা সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করি না— এটাই বড় দুর্বলতা। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হলে সেখানে দুর্নীতি ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল সমস্যা এটাই। আমাদের সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানি বহু গুণে বাড়লেও সে অনুযায়ী বন্দর অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।

মিনার রশীদ আরো বলেন, যদি দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক বার্থ থাকত, তাহলে এই সংকট তৈরি হতো না। কাজেই নতুন টার্মিনাল নির্মিত হলে এসব সমস্যা অনেকটাই হ্রাস পাবে। তাই কোনো অভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানি নতুন টার্মিনাল তৈরি করতে চাইলে, তা সবাইকে উৎসাহিত করা উচিত। তবে ইতোমধ্যে নির্মিত টার্মিনাল বিদেশি ব্যবস্থাপনায় দেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বিশেষ করে যারা নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকি তৈরি করতে পারে— তাদের ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা দরকার।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি বন্দর দিবসের সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বন্দর পরিচালনা সরকারের নীতি-নির্ধারকরা ঠিক করবেন। সব রকমের প্রস্তুতিই বন্দরের আছে। তবে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মনোপোলি ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এই রাশ টেনে ধরার পাশাপাশি বন্দরের সক্ষমতা আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাজারে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম বাড়াতে হলে গ্লোবাল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।