Image description

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৫০ শয্যার এ হাসপাতাল জেলা সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় অর্ধশত এবং অপর পাশে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

প্রত্যন্ত গ্রামে হওয়ায় উপজেলা হাসপাতালই ভরসা প্রসূতিদের। কিন্তু প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ ও জরুরি সংকট ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাও নেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটিতে। রক্তক্ষরণ ও মৃত্যুঝুঁকি থাকলে রোগীদের পাঠাতে হয় জেলা সদর কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে। এতে সন্তান প্রসবের আগে পথেই মারা যাচ্ছেন অনেক নারী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সাঘাটা উপজেলা হাসপাতালটি চলছে মাত্র তিনজন চিকিৎসক দিয়ে। নেই রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা। পাওয়া যায় না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এতে সেখানে গর্ভকালীন সেবা নেওয়ার হার অত্যন্ত কম। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করাতে আসেন মাসে ৫০ জনের মতো নিরীহ ও অসহায় নারী।

সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজিয়া আফরিন আমার দেশকে বলেন, ‘চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি রক্তক্ষরণসহ অন্যান্য জটিলতা মোকাবিলার মতো প্রয়োজনীয় লোকবল ও ব্যবস্থা নেই। জোড়াতালি দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।’

স্থানীয় পর্যায়ের এমন দুর্দশা শুধু উত্তরের এ উপজেলাতেই নয়, দেশের অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরও একই অবস্থা। এ অবস্থায় গত এক যুগে গর্ভকালীন সেবায় বাংলাদেশ বেশ সাফল্য দেখালেও উদ্বেগজনক পর্যায়েই রয়ে গেছে প্রসূতি মৃত্যুর হার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রসূতি মৃত্যু ঠেকাতে গর্ভকালীন সেবার মান বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু এ জায়গায় ঘাটতি অনেক বেশি। অবস্থার উত্তরণে যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, তার চরম ঘাটতি উঠে এসেছে খোদ সরকারি তথ্যেই। ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালসহ সরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং সুবিধা অত্যন্ত কম। পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, কম ওজন এবং পূর্ববর্তী গর্ভধারণ কিংবা প্রসবে জটিলতার ক্ষেত্রে নারীদের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণেরও কোনো উদ্যোগ নেই। এসব সংকটের সমাধান না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হবে।

দেশের স্বাস্থ্যসেবার এমন অবস্থায় আজ বুধবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্যÑ‘মাতৃস্বাস্থ্যে সমতা; বাদ যাবে না কোনো মা’।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে প্রসবজনিত নারী মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬৩ জন। এর মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশের মৃত্যু হয় রক্তক্ষরণজনিত জটিলতায়। ২৩ শতাংশ মারা যান খিঁচুনিতে এবং ২১ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয় অন্যান্য জটিলতায়। এ ছাড়া গর্ভপাত ও সন্তান জন্মদানকালেও অনেকের মৃত্যু হয়ে থাকে।

বিডিএইচএস বলছে, রক্তক্ষরণ হলে জটিলতা তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে জরুরি সেবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে প্রসূতিকে হাসপাতালে না আনা এবং আনলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। আর এর ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুর ৮৫ ভাগই হয় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। অথচ এসব রোগীর ৪৩ শতাংশকেই সেবার জন্য ছুটতে হয় দুইয়ের বেশি সেবাকেন্দ্রে।

একই সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, দেশের উপজেলা হাসপাতালে মাত্র এক-তৃতীয়াংশে পূর্ণাঙ্গ রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে যেসব ইউটেরোটনিক ওষুধ হাসপাতালে থাকা জরুরি, সেগুলোর পর্যাপ্ততা শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। এ ছাড়া ঘাটতি রয়েছে একলাম্পশিয়া প্রতিরোধে অ্যান্টিকনভালস্যান্ট ওষুধের। উপজেলা পর্যায়ে এ ওষুধ আছে মাত্র ৩৩ শতাংশে। আর স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়ার অবস্থা আছে মাত্র ৩৫ শতাংশের। এসব সংকটে মৃত্যুর ৪৮ শতাংই হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। এ ছাড়া বাড়িতে ১৯ শতাংশ, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে গিয়ে মারা যাচ্ছে আরো ১৯ শতাংশ নারী। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায় ১৩ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ জুবায়ের চিশতি আমার দেশকে বলেন, ‘প্রসূতি মৃত্যুর বড় কারণ প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। এটি ব্যবস্থাপনায় বছরের পর বছর ধরে জোর দিলেও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধু এ সরকারকে দুষলেই হবে না, চিকিৎসক থেকে শুরু করে অন্যান্য অংশীজনেরও অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। নতুন সরকার আসার পরও অবস্থা একই রয়ে গেছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্য কার্যক্রম জানায়, বর্তমানে স্থানীয় ব্যবস্থায় প্রায় ৪০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানা উপায়ে রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও লোকবলসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৭০টিতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচি মা, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য (এমএনসিএইচ) বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. এসএম আবদুল্লাহ মুরাদ বলেন, ‘এখনো সব উপজেলায় রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। রয়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবও। তবে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে মৃত্যু ঠেকাতে সরকারের এসব সংকটের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতার ঘাটতিও বড় কারণ।’

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭৮৪টি সন্তান প্রসব হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৮৩২টি এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়েছে ৯৫২টি। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গেছেন ৭ নারী।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফারজানা সোহেল বলেন, ‘মৃত্যু কমাতে হলে গর্ভকালীন সেবা, জরুরি ব্যবস্থাপনা মোকাবিলা ও গর্ভ-পরবর্তী সেবা সর্বোচ্চ মানে নিতে হবে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে এসব সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। সেখানে প্রসব-পূর্ব ও পরবর্তী রক্তক্ষরণ ব্যবস্থাপনার অভাব, পরিবহন ব্যবস্থার জটিলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হওয়াই বড় সমস্যা।’