
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। উপজেলার কুশলপুর গ্রামের সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অর্জন করেছে দেশসেরার মুকুট। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে অজপাড়াগাঁয়ের এই বিদ্যাপীঠ। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসছেন দেখতে, কেউ শিখছেন শিক্ষাদানের পদ্ধতি, যা প্রতিষ্ঠানটিকে এনে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব।
সম্প্রতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে রাজধানীর মিরপুরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আয়োজিত অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ঘোষণা করেন শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায়।
ব্যতিক্রমী পাঠদান পদ্ধতি, খেলাধুলা ও নির্মল বিনোদন, সৌন্দর্য, শিশুবান্ধব পরিবেশ এবং অভিভাবকদের সহযোগিতায় নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষকদের আন্তরিকতায় এ বিদ্যালয়ের গৌরব ছড়িয়েছে দিনাজপুর, রংপুর ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে।
গত বছর রংপুর বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় বিদ্যালয়টি। ২৬ ডিসেম্বর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে উপপরিচালকের কাছ থেকে শিক্ষাপদক গ্রহণ করেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক। পরে ২৯ ডিসেম্বের জাতীয় পর্যায়ে মূল্যায়নের অংশ হিসেবে ঢাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, ৬৩ শতক জমিতে প্রাচীর ঘেরা সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ, যা দেখলেই মন ভরে যায়। চারপাশে ঘিরে রাখা দেয়াল, ভবনের ওয়ালের উভয় পাশ এমনকি ছাদেও আঁকা হয়েছে বিভিন্ন ফুল, ফল ও প্রাণীর ছবি। সব ছবির পাশে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর নাম লেখা হয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে। প্রধান দরজা দিয়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় দুপাশে স্বগত জানাবে বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ। সেগুলোয় শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ফুল।
বিদ্যালয় চত্বরে রয়েছে দোলনা, সরাৎ, ঢেঁকিকলসহ বিভিন্ন খেলার সরঞ্জাম। ভবনের সামনে রয়েছে সততা স্টোর ও শহীদ মিনার। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালগুলোয় বাংলা-ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের পাশাপাশি মানচিত্র, সৌরজগত, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী চিত্রায়ন করা হয়েছে। দেয়ালগুলো যেন একেকটি বইয়ের পাতা হয়ে ধরা দিয়েছে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের কাছে। শিশুবান্ধব এমন নৈসর্গিক, ঝকঝকে, পরিপাটি ও মনোরম পরিবেশ দেখতে স্থানীয়দের পাশাপাশি আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকেও আসছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
চিরিরবন্দর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে কুশলপুর গ্রাম। এখানে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন জগদীশ চন্দ্র রায়। মূলত তার হাত ধরেই বিদ্যালয়টি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অর্জন করে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, উৎসবমুখর পরিবেশে পাঠদান করায় তারা আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করে। মাতৃস্নেহে শিক্ষা দেওয়ায় প্রতিদিন ক্লাসের জন্য মুখিয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা।
অভিভাবকরা জানান, এ বিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য শিশুদের নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না। স্কুলে যাওয়ার জন্য সাধারণত সন্তানদের চাপাচাপিও করতে হয় না।
জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বিদ্যালয়বিহীন ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প নেয় সরকার। শর্ত ছিল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কেউ জমি দান করলে ভবন ও শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব নেবে সরকার। তখন উদারতার পরিচয় দেন সুব্রত খাজাঞ্চীর ছোট ভাই বিরাজ খাজাঞ্চী ও সুনীল কুমার সরকার। বিরাজ পেশায় প্রকৌশলী, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
তিনি জানান, বিদ্যালয়ে সরকারি বেতনভুক্ত শিক্ষক পাঁচজন। তবে স্থানীয়দের আর্থিক সহায়তায় চারজন খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ ছয়টি। একটিতে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া, যেখানে বিভিন্ন ছবি প্রদর্শন করে শিশুদের পাঠদান চলে। বিদ্যালয়ে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি টিনশেড হলরুম রয়েছে। সেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। হলরুমের সামনে খেলার মাঠ। মূল একতলা ভবনের ছাদের তিন পাশে করা হয়েছে বাগান। এক পাশে মুক্তমঞ্চ। সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়।
প্রধান শিক্ষক জানান, ২০১৭ সালে প্রথমবার সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৫ শিক্ষার্থী। তাদের সবাই জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। দুজন সাধারণ গ্রেডে এবং একজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পায়। এরপর ২০১৮ সালে ৩৬ জনের মধ্যে ৩১ এবং ২০১৯ সালে ৩৮ জনের মধ্যে ৩৫ জন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ২০২২ সালে বিশেষ বৃত্তি পরীক্ষায় ১০ শতাংশ হারে ওই বিদ্যালয় থেকে সাতজন অংশ নিয়ে দুজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। শুধু পড়ালেখা নয়, ২০১৭ সালে ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলাপর্যায়ে বিদ্যালয়টি রানার্সআপ হওয়ার গৌরবও অর্জন করে।
বিরাজ খাজাঞ্চী জানান, তার বড় ভাই সুব্রত খাজাঞ্জী দিনাজপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মৃত ভাইয়ের স্মরণে বিদ্যালয়টির নামকরণ করেন তিনি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিনারা বেগম বলেন, এটা পুরো চিরিরবন্দরের জন্য গৌরব ও সম্মানের। বিদ্যালয়টির ভবন সম্প্রসারণের জন্য অধিদপ্তরে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। দ্রুতই কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ‘এ অর্জন সত্যিই অনেক গৌরবের। আন্তরিকতা আর সহযোগিতার মনোভাব থাকলে গ্রামের স্কুলগুলো যে আলো ছড়াতে পারে, সুব্রত খাজাঞ্চী তারই প্রামাণ। সুব্রত খাজাঞ্চী স্কুল আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা উন্মুক্ত থাকবে।’