Image description
পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকা-না থাকা

পুলিশের হাতে ‘মারণাস্ত্র’ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত সোমবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মারণাস্ত্র থাকবে শুধু এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) কাছে। পুলিশ তাদের কাছে থাকা মারণাস্ত্র জমা দেবে। এখন কথা হচ্ছে পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকা না থাকা নিয়ে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, কী অস্ত্র আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্দেশনা। সেখানেই কাজ করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কথায় কথায় টিগার টিপার অভ্যাস থেকে পুলিশকে বের করতে হবে। ফলে সরকারের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক।

সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, মারণাস্ত্র বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে। পুলিশের হাতে কোন অস্ত্র থাকবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, পুলিশের হাতে কোন অস্ত্র থাকবে, তা ঠিক করবে সরকার গঠিত একটি কমিটি। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঐ কমিটি সুপারিশ করবে পুলিশের হাতে আসলে কোন ধরনের অস্ত্র থাকবে।

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, রাইফেলের মতো যেসব অস্ত্রের গুলিতে মানুষ মারা যেতে পারে সেগুলো ব্যবহারে পুলিশকে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। পুলিশ কোনো কিলার ফোর্স হতে পারে না। পুলিশের কাছে বড়জোর শটগান থাকতে পারে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিষয়টা মিন করেছে সেটি হচ্ছে যে অস্ত্রের গুলির ফলে নিশ্চিত মৃত্যু যেমন—রাইফেল। রাইফেল থেকে বুলেট নির্গত হয়। এগুলো আমরা এভয়েড করব। আমরা আর্মামেন্টেরিয়াম (অস্ত্রাগার) নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ইত্তেফাককে বলেন, পুলিশের অস্ত্রের ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়ার আগে এটা মাথায় রাখতে হবে যে অপরাধীরা কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। একটি কারণে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা যেন অন্যভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ না হয়। মূলত অস্ত্র সমস্যা নয়। সমস্যা হলো নির্দেশনা, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল। পুলিশ যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে, বলতে গেলে সবই প্রাণঘাতী অস্ত্র। অর্থাত্, যে অস্ত্রকে অ-প্রাণঘাতী মনে করা হচ্ছে, তাও সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এখন দেখতে হবে সরকার গঠিত বিশেষ কমিটি কি ধরনের নির্দেশনা দেয়। আগে কৌশল ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই সিদ্ধান্তে যেন উলটো সংকট বেড়ে যায়। কারণ পুলিশ আইনের মধ্যে থেকে বল প্রয়োগ করে বা করতে হয়। আসামি ধরতে গেলে বা ওয়ারেন্ট তামিল করতে গেলেও বল প্রয়োগ করতে হয়। এখানে সুপারভিশনটা গুরুত্বপূর্ণ। কথা হচ্ছে, পুলিশ যাকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে তার হাতে যদি অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকে সেক্ষেত্রে কী ধরনের সংকট হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হয়। সেখানে এপিবিএন ডেকে আনার মতো সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। তখন পুলিশ সদস্যরা কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন?

তবে পুলিশের আরেক জন সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা ইত্তেফাককে বলেন, কথায় কথায় ট্রিগার টিপার জায়গা থেকে পুলিশকে ফেরাতে হবে। নিকট অতীতে আমাদের যে অভিজ্ঞতা সেটা তো ভালো না। ফলে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। আর যে কথা বলা হচ্ছে, পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র থাকবে না বিষয়টা তো তেমন নয়। রাইফেল, ৯ এমএম পিস্তলসহ কিছু অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা হচ্ছে। কিন্তু শটগান তো থাকবে। পাশাপাশি একটা অভিযানে গেলে অন্তত একজন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা থাকেন। তার কাছে তো পিস্তল থাকছে। আর সারা দেশেই এপিবিএন আছে। প্রয়োজন হলে তাদেরও ডাকা যেতে পারে। ফলে দ্রুততম সময়ে যে তাদের পাওয়া যাবে না, এমনটি নয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আ ন হ মুনিরুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাকে আমি সঠিক বলে মনে করি। পুলিশের সবার কাছে মারণাস্ত্র থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষ অপারেশনের সময় তো এপিবিএনকে ডেকে নেওয়া যাবে। আমি মনে করি, এতদিন যে পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র ছিল সেটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। বিশ্বের বহু দেশে পুলিশের হাতে কোনো অস্ত্র থাকে না। কেন তাদের অস্ত্র বহন করতে হবে? সব সময় তো এটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি মনে করি না, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে কোনো সংকট হবে। বরং পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেখান থেকে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়বে।   

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর পর দেখা যায়, ছররা গুলিতে তার বুক ও পেট ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আবু সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম। তিনি তখন বলেছিলেন, পুলিশের ছররা গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। ১০ মিটারের মধ্যে গুলি করায় তার (সাঈদ) শরীরের ভেতরের কিছু অঙ্গ ফুটা হয়ে গিয়েছিল। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে : বাংলাদেশে পুলিশ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সাধারণত লাঠিচার্জ, গরম পানি ও রঙিন পানি ছেটায় এবং কাঁদানে গ্যাস (টিয়ার শেল) ব্যবহার করে থাকে। ২০১৩ সাল থেকে সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার শুরু হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে ব্যাপকভাবে পুলিশকে সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার করতে দেখা যায় ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে।

সাধারণত বেশি বল প্রয়োগ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে শটগান ব্যবহার করা হয়। অস্ত্রধারী অপরাধীকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু এ ধরনের অস্ত্রের নির্বিচার ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা হয়েছে। সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। বাংলাদেশ পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এখন পুলিশ বাহিনীতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এবং ৯ এমএম ক্যালিবারের অস্ত্র রয়েছে। তবে ৯ এমএম পিস্তলই বেশি। এছাড়া পুলিশের কাছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়নিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান (এসএমজি) ও লাইট মেশিনগান (এলএমজি) রয়েছে। একসময় পুলিশের কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল, অবশ্য এখন আর এই অস্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নির্বিচার গুলি করেছে, সেক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও রাইফেলের ব্যবহার বেশি ছিল। এসএমজি ও এলএমজির মতো অস্ত্রও ব্যবহূত হয়েছে কোথাও কোথাও।