
কালের অতলে ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে এক্কান্নবর্তী সংসার জীবনের সুমধুর-সোনারাঙা অতীত। যা ছিলো বাঙালির হাজার বছরের পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে। এখন সমাজের আকাশে যৌথ পরিবার নামক দুয়েকটি নক্ষত্রের দেখা মিললেও নেই সেখানে প্রাণবন্ত আবেগ-আবেশ আর ভালোবাসার নিবিড় বন্ধন। একক পরিবারের কালো ছায়ায় গড়ে উঠছে স্বার্থপর,হতাশাগ্রস্ত এক সমাজ। বাড়ির ভেতর সুখের ওড়াউড়ি নেই। শহরে দুরন্ত শৈশব আটকে পড়েছে বারান্দার গ্রিলে। সমাজ গবেষকরা বলছেন,গ্রামাঞ্চলে মাত্র ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে ম্রিয়মান হয়ে। সেখানে এক-আধটু যৌথ পরিবারের মৃদু ঝলকানি চোখে ভাসলেও যেন তাতেও লেগেছে ক্ষয়িষ্ণু চন্দ্রগ্রহণ। যুগের হাওয়ায় যৌথ পরিবার ভেঙে যেতে যেতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন তিন জন কিংবা চার জনে এসে ঠেকেছে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত উদয়াস্ত।
কসমোপলিটন শহুরে জীবনে একান্নবর্তী পরিবার এখন আর চোখে পড়ে না। অতীতের সেই একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র ছিল ভিন্ন,সে যেন এক গল্পকথা। সেই জীবন্ত রূপকথার প্রধান চরিত্রে থাকতেন দাদা বা নানা,যিনি হতেন পরিবারের কর্তা এবং তিনি বটবৃক্ষের মতো পুরো পরিবারকে ছায়া দিয়ে,মায়া দিয়ে রাখতেন। আগলে রাখতে ঝড়-ঝাপটা থেকে। সংসারের সকল সিদ্ধান্ত তারাই নিতেন এবং তাদের সিদ্ধান্তেই পরিবার-সংসার পরিচালিত হতো। এই কর্তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি ছিলেন গল্পের অন্যান্য চরিত্র। সমাজের প্রথা অনুযায়ী কর্তা বাড়ির মেয়ে বিয়ে দিয়ে অন্য সংসারে পাঠাতেন আর ছেলে বিয়ে দিয়ে ছেলের বউ নিজ সংসারে আনতেন। কর্তার স্ত্রী অর্থাত্ দাদী ছিলেন সংসারের কর্ত্রী। সংসার দেখাশোনা ও রান্নাবান্নার দায়িত্ব ছিল ছেলের বউদের। নাতি-নাতনীরা দাদীর কাছেই বড় হতো। দাদী ছিল তাদের গল্পবুড়ি।
মজার মজার ভূতের গল্প, রাক্ষস আর খোক্ষসের গল্প দাদীর কাছে শুনেই বড় হতো এই যৌথ পরিবারের সন্তানেরা। প্রতিটি পরিবার ছিল ভালোবাসা-মায়া-মমতার বিনে সুতোয় গাঁথা। তবে এগুলো সবই এখন কল্পকথা। ধীরে ধীরে সেই বটবৃক্ষের ছায়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে পারিবারিক জীবন। কবি পূর্নেন্দু পত্রীর ভাষায়:’একান্নবর্তীর দীর্ঘ দালান-বারান্দা ছেড়া কাগজের কুচি হয়ে গেল..’।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন,ডিজিটাল সময় যেন সবকিছুকেই দ্রুত যান্ত্রিক করে দিচ্ছে। পরিবার,সম্পর্ক, হূদ্যতা সব চলে এসেছে হাতের মুঠোয়;মোবাইল ফোনের নীল মনিটরে। আঙুল ছুঁয়ে দিলেই ভেসে উঠছে প্রিয় কারো ছবি-নাম। তা যেন আজ এক পংক্তি কথোপথনের মধ্যেই হয়ে গেছে সীমাবদ্ধ। পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ঝর্ণায় ছিল বাঙালি সিক্ত, সেখানে জমেছে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমশ উঠে যেতে বসেছে। পড়ে আছে চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই মর্মছোঁয়া বিমর্ষ অনুভূতি। নাগরিক জীবনে বহুকাল ধরে জীবন এখন একচিলতে বারান্দা, একরত্তি জানালা আর মুক্ত আকাশবিহীন আচ্ছাদনের ঘেরাটোপে আবৃত হয়ে আছে। পারিবারিক সম্পর্কের স্বপ্ন এখানে ধুলো জমা, পিয়ানো, গিটার, ভায়োলিন, সেতার, এস্রাজ, তানপুরা-হারমোনিয়ামের অবয়বের মতো অবরুদ্ধ।
কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানি এবং মনোবিশ্লেষকের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, একাধিক কারণে গ্রামাঞ্চলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির বিকাশের প্রভাব ছাড়াও বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব, ননদ-ভাবির দ্বন্দ্ব, একা থাকার প্রবণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা অন্যতম। তারা জানান, যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় পারিবারিক অশান্তি, কলহ, বিবাদ ও অবিশ্বাসের ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়া অধিকাংশ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরিজীবী থাকায় তাদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। তাদের মতে,এখন পরিবার বা আত্মীয়দের কেবল চেহারাটা চেনা চেনা। কেউ কারো কুশলও জিজ্ঞেস করে না,অথচ একই ছাদের নিচে বসবাস। এসব পরিবারের বিনোদন বলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম,স্যাটেলাইট দুনিয়া টিভি ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত মানুষের জীবনজুড়ে বাড়ছে অস্থিরতা। ওটিটি,বহুমাত্রিক সোসাল মিডিয়া, হিন্দি সিরিয়ালের মতো দীর্ঘ হচ্ছে পরিবারের পারিবারিক কলহও; যে কারণে ভাঙছে সংসার, পুড়ছে জীবন। বাড়ছে আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির ঢাকা শহরে একান্নবর্তী পরিবার এখন আর চোখে পড়ে না। নগরজীবনের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন তথা জীবনের প্রতিটি ছত্রে জেগে আছে নড়বড়ে প্রহরের ছত্রখান গল্প। যে গল্পের শুরু আর শেষার্ধেও নেই উজ্জীবনের প্রাণোচ্ছলতা। ক্ষীণ জীবনবোধের ভেতরেই যেন থমকে গেছে প্রজাপতি মন। এখন ‘সেলফ ফ্যামিলি ম্যানারিজম’ সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। শহুরে নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির অপূর্বময়তার সংস্পর্শ থেকে যেমন আজ বঞ্চিত। সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সঙ্কটে আছে ছোট পরিবারগুলোও!
সমাজ বিজ্ঞানি অধ্যাপক ড.নেহাল করিম বলেন, আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির বিকাশের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এ সামাজিক পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি প্রয়োজন। নতুবা মানুষের আন্তরিকতা এবং সমপ্রীতি দিন দিন কমতেই থাকবে। তিনি বলেন, মুলত:স্বাধীনতার পর থেকে ভাংতে থাকে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। ১৯৭৮ সালে যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে চাকরি নিয়ে ব্যাপকভাবে লোক যাওয়া শুরু করে তখন থেকে ভাঙনটা বড় রূপ নেয়। গ্রাম থেকে মানুষ শহরে চাকরি-লেখাপড়া নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সবাই স্বাবলম্বী হতে থাকে। তখন যৌথ পরিবারের উপযোগিতা তাদের কাছে ম্রিয়মান হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন। উত্সবের বাড়ি বা শোকের বাড়ি ছাড়া কারো দেখা সাক্ষাত্ হয় না সেখানে ’কেমন আছো’- এমন কথাবার্তায়ইশেষ হয় কুশল বিনিময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.ফাতেমা রেজিনা ইত্তেফাককে বললেন,একান্নবর্তী পরিবার ছিন্ন জীবনসংসার পাখির বাসার মতো। একটি -দুটি ছোট ঘর,ছোটসংসার,ছোটপরিবার; যেখানে বসবাস করে কেবলমাত্র মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলে-মেয়ে। যেখানে নেই অপরিমেয় কোনো আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ। পূর্বের সেই একান্নবর্তী পরিবারে যারা কর্তা-কর্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। ফলাফল, তারা যে পরিবারের সদস্য সেটা শিশুরা জানছেই না, ওদের মধ্যে দাদা-দাদী, চাচা-ফুফুদের প্রতি ভালেবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতা গড়ে উঠছে না। এই না জানার মূলে রয়েছে ওদের বাবা-মা। তাদের মধ্যেই এই মেনে নেওয়াটা ফুটে উঠছে না। বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে তার জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী। এই পরিবারের শিশুরা শিশুবয়স থেকে একা থাকতে থাকতে জন্মায় স্বার্থপরতা, জানে না ভাগাভাগির আনন্দ, ত্যাগের মহত্ব। শাসন না পেয়ে হয়ে উঠছে স্বেচ্ছাচারী, গড়ে উঠছে না কোনো হিতাহিত বোধ বা শিষ্টাচারশিক্ষা, যা শিশুর ভবিষ্যত অন্ধকার করে দিচ্ছে। ড.ফাতেমা রেজিনার মতে,একান্নবর্তী পরিবার আর সমাজে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি। যেমন জাপানে একান্নবর্তী-যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। সেখানেতো বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও তারা এটা ধরে রেখেছে। এবং এর সুফলও ভোগ করছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ পরিবার ধরে রাখার জন্য উত্সাহিত করা হচ্ছে। আমরাও তাদের অনুসরন করতে পারি। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উত্সাহিত করতে পারি একান্নবর্তী পরিবার গড়ে তোলার জন্য।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, দিন দিন যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা কমে আসছে। যৌথ পরিবারের সদস্যরা কখনোই একাকিত্বে ভোগে না। তাদের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না ভাগাভাগি করার অনেক মানুষ থাকে। এ ছাড়া যেকোনো দুর্ঘটনায় মানসিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন অতি সহজেই তারা পরিবারের অপর সদস্যদের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। এ জন্য ওদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বসামপ্রতিক এক তথ্য বলছে, পরিবারের সদস্যের আকার ছোট হয়ে চার জনের নিচে নেমে গেছে। এক দশক আগে ছিল প্রায় সাড়ে চার জন। বর্তমানে সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ জন। পরিবার ছোট হওয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমেছে। দেশে এখন বার্ষিক গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং এক দশক আগে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।