
দেশ জুড়ে শিল্প খাতে গ্যাস-সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, ভালুকা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ সব প্রধান শিল্পাঞ্চলেই কমে গেছে গ্যাস সরবরাহ। উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, সিরামিক ও স্টিল খাতসহ বিভিন্ন শিল্পে। ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়।
শিল্পমালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক-তৃতীয়াংশ শিল্পকারখানায় দিনে গ্যাসের চাপ নেই। রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি থাকে। ফলে এ সময় উত্পাদন চলছে। বাকি সময় শ্রমিক-কর্মীরা বেশির ভাগ অলস সময় কাটান। অনেক কারখানা শ্রমিক ছাঁটাইও করেছে। দিনভর যন্ত্রপাতি বন্ধ রেখে রাতের শিফটে উত্পাদন চালু রাখার কারণে ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিছু শিল্প সিএনজি, এলপিজি বা ডিজেল দিয়ে উত্পাদন ধরে রাখার চেষ্টা করলেও সেটিও ব্যয়বহুল। সবমিলিয়ে নির্ধারিত সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের রপ্তানিপণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না অনেকে। চাহিদা থাকলেও রপ্তানি কার্যাদেশ নেওয়া বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছেন উল্লেখযোগ্য শিল্পোদ্যোক্তা। এর প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয়ে। মার্চের চেয়ে এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১২৩ কোটি ডলার।
গাজীপুরের একটি নিটিং কারখানার পরিচালক জানান, তারা দৈনিক প্রায় ৭০ টন সুতা উত্পাদন করতেন। বর্তমানে করছেন ১২-১৩ টন। নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানার মহাব্যবস্থাপক জানান, তারা ১০ পিএসআই চাপে গ্যাস পাওয়ার কথা। কিন্তু গত দুই বছর ধরে পাচ্ছেন ২ থেকে ৪ পিএসআই। ফলে দুই-তৃতীয়াংশ উত্পাদন কমে গেছে। অথচ কম চাপে গ্যাস পেলেও তারা তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে নির্ধারিত চাপ অনুযায়ী বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাত্ প্রকৃত গ্যাস না পেয়েও অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সাভার ও আশুলিয়ায় ১ হাজার ২০০র বেশি কারখানা রয়েছে। তিতাসের গ্যাস সরবরাহ যথেষ্ট না হওয়ায় কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে এসেছে ১ থেকে ৩ পিএসআইয়ে।
অথচ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই। ফলে জেনারেটর চালু করা যাচ্ছে না, বয়লার গরম করা যাচ্ছে না। এমনকি প্রায় সময় ড্রায়ার মেশিন বন্ধ থাকায় সময় মতো তৈরি পোশাক ওয়াশও করা যাচ্ছে না। সাভারের এক গার্মেন্টসের উপমহাব্যবস্থাপক বলেন, গ্যাস না পেয়ে ডিজেল দিয়ে মেশিন চালাচ্ছেন। তাতে মাসে ৫০ লাখ টাকার বেশি খরচ বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন না। এখন পরস্থিতি এমন লোকসান দিয়েও ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি ভবিষ্যত্ ব্যবসার আশায়।
পেট্রোবাংলা এবং শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। সর্বশেষ বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সরবরাহ করা হয় ২৬৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে ১০৪ কোটি ঘনফুট ব্যবহূত হয় বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতে, সাড়ে ১২ কোটি সার কারখানায়। শিল্প ও আবাসিকে যায় ১৫১ কোটি ঘনফুট গ্যাস।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৮৮ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস। চার বছর আগেও এই পরিমাণ ছিল ২৪৭ কোটি ঘনফুট। অর্থাত্ দেশীয় উত্পাদন কমেছে প্রায় ৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে হলে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। দেশে দৈনিক ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাত্ দেশীয় উত্স ও আমদানি মিলিয়ে বর্তমানে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা কমে গিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটেরও কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ভুল নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে এমন সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শিগিগরই এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নেই। বর্তমান সরকার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বকেয়া পরিশোধ করে গ্যাস উত্পাদন ও এলএনজি আমদানিতে কিছুটা গতি আনলেও সার্বিক চাহিদা বিবেচনায় তা যথেষ্ট নয়। বর্তমানে জ্বালানি ও বিদ্যুতে যেভাবে নীতি সাজানো হচ্ছে এবং পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার তা সুসংহতভাবে এগিয়ে নিলেও সংকট দূর করতে কমপক্ষে ৩-৪ বছর লাগবে। তবে কর্তৃপক্ষকে ত্রৈমাসিক পরিকল্পনা করে ধীরে ধীরে ঘাটতি কমিয়ে আনতে মনোযোগী হতে হবে।
গত কয়েক বছর ধরে যখনই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে তখনই স্থানীয় উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ এবং এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বলেছে সরকারি সংস্থা ও কোম্পানিগুলো। কিন্তু দাম বাড়লেও উত্পাদন ও সরবরাহ বাড়েনি। ২০২৩ সালে সরকার গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ বাড়ায় তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। চলতি বছর আবার ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার পরও সংকট কাটেনি।
গত ৭ মে শিল্পপতিদের সঙ্গে এক বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, রমজানে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি সামলাতে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছিল। এখন বিদ্যুত্ থেকে নিয়ে হলেও শিল্পে সরবরাহ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে।