
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর বিরুদ্ধে ভূমিহীনদের জমি জোর করে দখলের অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভূমিহীনদের লিজ দেওয়া অন্তত ১০০ বিঘা সরকারি জমি দখল করে মাছ, মাল্টা ও কমলালেবুর প্রকল্প গড়ে তোলেন মিয়াজী। সেই সঙ্গে ওই প্রকল্পে গড়ে তোলা হয় আমোদ-প্রমোদের স্পট। স্থানীয়রা বলছেন, জমি দখল করা নেশায় পরিণত হয়েছিল সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর। সম্প্রতি এসব জমি ফেরত পেতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন ভুক্তভোগী ভূমিহীনরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহেশপুর উপজেলার স্বরূপপুর ইউনিয়নের তৈলতুপি মৌজার উখরির বিলের আরএস ৫০২ ও ৫০৩ নম্বর দাগের সরকারি জমি ১৯৯৬ সালে ২৮টি ভূমিহীন পরিবারকে বন্দোবস্ত দলিলে রেজিস্ট্রি করে দেয় তৎকালীন সরকার। সে সময় দলিলপ্রতি ৫০ শতক করে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। দলিলে ৫০ শতক জমির উল্লেখ থাকলেও ভূমিহীনরা তিন থেকে চার বিঘা অতিরিক্ত জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদ করতেন। ২০১০ সালে ওই জমিতে নজর পড়ে শেখ হাসিনার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব.) সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর। সেই থেকে জমি দখলে নানান অপকৌশল নিতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে ভূমিহীন পরিবারের সদস্যদের ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে জমি লিজ দিতে রাজি করান। যেসব ভূমিহীন জমি লিজ দিতে রাজি হননি ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তাঁদের জমি জোর করে দখল করেন মিয়াজী। এরপর বেশির ভাগ জমির লিজের মেয়াদ শেষ হলেও ভূমিহীনরা এখনো তাঁদের জমি ফেরত পাননি। এমনকি যেসব জমি লিজ নিয়েছেন তার জন্য ভূমিহীনদের কোনো টাকা দেননি সালাহ উদ্দিন মিয়াজী।
এ ছাড়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকার একটি পরিবারের ৩২ বিঘা জমি দখল করতে ওই পরিবারের সদস্যদের নামে শতাধিক মামলা দিয়েছেন মিয়াজী। মামলা থেকে বাদ যায়নি পরিবারটির নারী সদস্যরাও। ওই পরিবারে সদস্যদের নামে চাঁদাবাজি, লুটপাট, চুরিসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা দিয়েও হয়রানি করেছেন মিয়াজী।
ওই পরিবারের একজন ভুুক্তভোগী ইউনুচ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাসিনার সামরিক সচিব হওয়ার পর থেকে মিয়াজী আমাদের জমি দখলের চেষ্টা করেন। জমি নিজের দখলে নিতে তাঁর ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আমাদের ওপর অমানবিক জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছেন। জমি দখল করা যেন তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল।’
আরেক ঘটনায়, মহেশপুরের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের ৬০ নম্বর ডুমুরতলা মৌজার এসএ ৫৪৫ খতিয়ানের ৫৩২৫৬৯ নম্বর দাগে ৯৯২ শতক জমির মালিক সুফিয়া খাতুন। ১৯৬৮ সালের ১৩ জুলাই ৮৯৭৬ নম্বর দলিলে সুফিয়া খাতুনের কাছ থেকে ওই জমি কেনেন কৈখালী গ্রামের আব্দুল হামিদ। ২০১০ সালে ওই জমিতে নজর পড়ে হাসিনার সামরিক সচিব সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর। ওই জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ভূমিহীনদের কাছ থেকে দলিল মূল্যে ওই জমি কিনেছেন মর্মে মালিকানা দাবি করে মিয়াজী শুরু করেন জমি দখলের পাঁয়তারা। ভুয়া দলিল বুনিয়াদে ১৪১৭, ১৪১৯, ১৪১৮, ১৪১৬ নম্বর কেসের মাধ্যমে নিজ নামে জমাখারিজ করেন মিয়াজী। তবে আব্দুল হামিদের করা মামলায় মিয়াজীর জমাখারিজ বাতিল ঘোষণা করে সরকার। পরে ভুয়া দলিল বানিয়ে আব্দুল হামিদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে মামলা দেন মিয়াজী।
পুঁটি মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তিকে দাতা সাজিয়ে ভুয়া দলিল করেন মিয়াজী। দলিলে ৮৯৭৬ নম্বর দেওয়া হলেও টিপ সিরিয়ালে দেওয়া হয় মাত্র ২৪২৭ নম্বর। দলিল নম্বর ও সিরিয়াল নম্বরে এমন গরমিলের কারণে যাচাই-বাছাই করে ওই দলিল ভুয়া প্রমাণিত হয় আদালতে। তখন থেকে শুরু হয় আব্দুল হামিদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও মামলা দেন মিয়াজী। এভাবে এরই মধ্যে শতাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ওই জমি দখল করেন সালাহ উদ্দিন মিয়াজী।
ভুক্তভোগী আব্দুল হামিদের পুত্র আব্দুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিয়াজীর সন্ত্রাসে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম জমি ছেড়ে দিতে। তখন আমাদের র্যাব-পুলিশের ভয় দেখিয়ে জমি দখলে নেন মিয়াজী।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শেখ হাসিনার সামরিক সচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর ব্যবহার করা মোবাইলে বহুবার ফোন করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে মহেশপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখানে সদ্য যোগদান করেছি। ভূমিহীনদের স্মারকলিপি পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।’