
Abu Saleh Yahya (আবু সালেহ ইয়াহিয়া)
বাংলাদেশের আইন জগতের অন্যতম কিংবদন্তি এবং আইন অঙ্গনে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের এক অমুল্য সম্পদ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাই কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।
মহান আল্লাহ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাইকে ক্ষমা করে দিন। ইসলামী আন্দোলন ও আর্ত-মানবতার জন্য আইনী জগতে উনার অবদানকে কবুল করে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করুন।
এইতো কিছুদিন আগেই, যুক্তরাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যাবার সময় লন্ডনে উনার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল।
কয়েক মাস আগে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় দেখা করতে গিয়ে উনার জীর্ণ-শীর্ণ শরীর দেখে আমাদের সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল, পরিপাটি, এভার স্মার্ট রাজ্জাক ভাইকে যেন চিনতেই পারছিলাম না। আমাদের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলনা। মন চাইছিল শেষ একটা ছবি তুলে রাখি। কিন্তু এমন শুকিয়ে যাওয়া শরীর দেখে শেষমেশ আর সাহস করিনি। তিনি খুব নিম্ন স্বরে আমাদের সাথে কথা বললেন। উল্টো আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সর্বাবস্থায় আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মধ্যেই কল্যাণ। আমি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আমরা মোনাজাত করে বাইরে এসে উনার সহধর্মিণী ও ছেলে ব্যারিস্টার এহসান ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানলাম, দ্রুত হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হবে। আপাতত কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পরবর্তী চিকিৎসা এখানে হবে না। আমরা যা বুঝার বুঝে গেলাম আর উনাদের উত্তম ধৈর্য্য ধারণের জন্য পরামর্শ ও দোয়া দিলাম।
কিছুদিন পর আবার রাজ্জাক ভাইকে কিছুটা চলাফেরা করতে দেখে যারপর নাই ভাল লাগছিল। দেশে চলে গেলেন। মিডিয়া ফেইস করলেন। আইনি অঙ্গনে আবারও লড়তে চাইলেন। মনের ও ঈমানের জোরে অনেকটা চেষ্টাও করলেন। কিন্তু শেষ আর হলোনা। আজহার ভাইকে সম্পুর্ন মুক্ত অবস্থায় দেখতে পারলে নিশ্চিয়ই তিনি অনেক বেশি তৃপ্তি বোধ করতেন।
রাজ্জাক ভাই ব্যাক্তিগতভাবে আমারও আইনজীবী ছিলেন। ২০১০ সালে ধর্মীয় অনুভূতির মিথ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে আমিও গিয়েছিলাম জামিন নিতে। সে সময় ব্যারিস্টার রাজ্জাক ভাই জামিন শুনানি করে আমাদের জন্য ৬ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করিয়েছিলেন।
এরপর উনার ঢাকার অফিসে দেখা হয়েছে অনেকবার।
লন্ডনে প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১৭ সালে। আমি তখন তুরস্ক থেকে লন্ডন বেড়াতে আসলে আইনি পরামর্শের জন্য উনার সাথে লম্বা মিটিং করেছিলাম।
লন্ডনে রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালের ডেন্টাল স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে তিনি পায়ে হেটে প্রায়ই উনার অফিসে যেতেন। আমিও আমার অফিসে যাওয়ার জন্য একই রাস্তা ব্যবহার করায় প্রায়ই মুখোমুখি হয়ে যেতাম রাজ্জাক ভাইয়ের। তিনি দাড়িয়ে যেতেন। আমার স্বাস্থ্য, পরিবার, প্রফেশন ইত্যাদির খবর নিতেন। আমিও উনার খবর নেয়ার চেষ্টা করতাম। খুব ভাল লাগত এটা দেখে যে, আমি অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ হওয়ার পরেও তিনি আমার নাম মনে রাখতেন এবং নাম ধরেই ডাকতেন। এরকম এক সাক্ষাতে উনার আরেক সুযোগ্য ছেলে ব্যারিস্টার ইমরান ভাই সাথে ছিলেন। তখন দেখলাম, ইমরান ভাইকে আমার শিবিরের সাবেক পরিচয়সহ আরও কিছু বললেন। সেদিন প্রায় ৭/৮ মিনিট দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমরা কথা বললাম। সাথে থাকা আমার মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করে তাকে আদর ও দোয়া করে দিলেন।
আমরা সবাই জানি, রাজ্জাক ভাই সবসময় নিচু স্বরে কথা বলতেন। উনার কথার মধ্যে ছিল অন্যরকম এক সম্মোহনী শক্তি। ধীরে ধীরে অনেক গুছিয়ে কথা বলতেন। কম বলতেন কিন্তু প্রেসাইজলি বলতেন। কথার ধরণ এবং অভিব্যক্তিতে ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানগত আভিজাত্যের ছোয়া লেগে থাকত।মামলার শুনানিতেও তিনি একই কায়দায় মুন্সিয়ানা দেখিয়ে যুক্তি তর্ক করতেন। যুক্তরাজ্যের আদালতে উনার ২ জন ক্লাইয়েন্টের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থেকে আমি সরাসরি তা প্রত্যক্ষ করেছি।
সন্দেহ নেই, তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন এবং আইন অঙ্গনে দেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। নিজের যোগ্যতার সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে অকাতরে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের সেবা করে গেছেন তিনি। শহীদ প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা সহ বহু বড় বড় ও আলোচিত অনেক মামলা পরিচালনা করা এবং সফল হওয়ার রেকর্ড রয়েছে তার পেশাগত জীবনে।
দেশের ও দেশের ইসলামী আন্দোলনের এক অমুল্য সম্পদ আজ দুনিয়া ছেড়ে রবের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। রাব্বুল আলামীন আমাদের সবার প্রিয় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের প্রতি রহম করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌসে উনার সাথে আবারও আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন। আমিন।