Image description
সেবার অভাবে মৃত্যু বছরে কয়েক হাজার

দেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই দুর্বল। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু জরুরি সেবা জোরদার করতে পারলে অনেক প্রাণ বেঁচে যেতে পারত। বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি বিভাগ বা এমার্জেন্সি ইউনিট থাকলেও সেখানে সেবা বলতে যা বুঝায় তা হলো- একজন মেডিক্যাল অফিসার ও কয়েকজন নার্স দায়িত্ব পালন করেন, তারা প্রাথমিকভাবে কিছু ওষুধও দেন। হাসপাতালে সিট থাকলে তারা রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীকে বিভিন্ন বিভাগে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া জরুরি বিভাগে রোগী আর কোনো সেবা পায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জরুরি বিভাগকে আরো উন্নত করতে পারলে অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে। জরুরি বিভাগ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিভাগই খোলা উচিত যেখানে জরুরি চিকিৎসার জন্য যা প্রয়োজন সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে আরো বেশি মানুষের উপকার হবে।

এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক রিজিওনাল অ্যাডভাইজার ও বর্তমান স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে প্রত্যেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থাকা উচিত যেখানে থাকবে জরুরি সব ধরনের চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি যেন রোগীর প্রাণ বাঁচানো যায়। এই বিভাগের অধীনে সব ধরনের সুবিধা সংবলিত অ্যাম্বুলেন্সও থাকবে। এই বিভাগটিকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন সঙ্কটাপন্ন সব ধরনের রোগীর জরুরি চিকিৎসা এখান থেকেই শুরু করা যায়। পরে সুযোগ বুঝে রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীকে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে পাঠিয়ে দিতে হবে। জরুরি ব্যবস্থাপনার জন্য এই বিভাগের সাথে থাকতে হবে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা, থাকবে একটি স্বতন্ত্র ব্লাড ব্যাংক। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসার উন্নয়ন হয়নি যেখানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও জরুরি বিভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পাঁচ হাজার ৩৮০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে সড়কে। ২০২৩ সালে মারা গেছে, পাঁচ হাজার ২৪ জন, ২০২২ সালে চার হাজার ৬৩৬ জন, ২০২১ সালে পাঁচ হাজার ৮৪ জন এবং ২০২০ সালে সড়কে মারা গেছে, তিন হাজার ৯১৮ জন। হাসপাতালে জরুরি বিভাগ শক্তিশালী থাকলে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধ করা যেত। বিগত বিএনপি সরকারের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের সেবা দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে একটি হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত ওই হাসপাতালটি আলোর মুখ দেখেনি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই হাইওয়েতে জরুরি সেবা দেয়ার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম নয় অন্যান্য সড়কে দুর্ঘটনায় আহত রোগীরাও সেবা পেতে পারত। দুর্ঘটনায় আহত হলে সাধারণত ব্রেইনে বেশি আঘাত লাগে, আবার কিডনি ফেইল করে। ফলে নিউরোলজির চিকিৎসা, কিডনির চিকিৎসা বিশেষ করে কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক দুর্ঘটনা কবলিত মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে। এই দুই অঙ্গ ছাড়া অন্যান্য অঙ্গে আঘাত লাগলেও জরুরি চিকিৎসার আওতায় আসতে হয়।

নিউরোলজির চিকিৎসার জন্য ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল রয়েছে। এ ছাড়া নিউরোলজির এ ধরনের হাসপাতাল আর নেই। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের জন্য একটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল যথেষ্ট নয়। ঢাকার বাইরে দেশের প্রতিটি বিভাগের এমন কমপক্ষে আরো ৭টি নিউরোলজি ও কিডনিসংক্রান্ত হাসপাতাল প্রয়োজন মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য। অন্য দিকে নিউরোলজি, ইউরোলজি ও নেফ্রলজি বিষয়ে বছরে হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছেন বাংলাদেশে। দেশে হাসপাতাল বাড়ানোর সাথে সাথে চিকিৎসা দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির প্রচেষ্টাকেও আরো জোরদার করতে হবে বলে চিকিৎসকরা জানান।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত এক রোগীর পুত্র মো: আল আমিন জানান, তিনি নরসংিদী থেকে বিকেলে এই হাসপাতালে এসে কাউকে ধরে জরুরি বিভাগে তার মায়ের জন্য একটি সিট ম্যানেজ করেন। কিন্তু সেখানে প্রায় ২০ ঘণ্টা মাকে রাখলেও তেমন কোনো চিকিৎসা হয়নি স্যালাইন ও কয়েকটি ইনজেকশন ছাড়া। পরে মাকে নিউরোলজি বিভাগে নেয়া হলে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকে রাখতে চাননি। তিনি আইসিইউ বিভাগে নিয়ে যেতে বলেন। শেষ পর্যন্ত আইসিইউ বিভাগে একটি সিট পাওয়া গেলেও পরের ২৪ ঘণ্টায় তার মা মারা যান। আল আমিন বলেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি বিভাগেই স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা পেলে তার মাকে হয়তো হারাতে হতো না।